শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২৪ অপরাহ্ন

বল্য বিবাহ ও আমাদের করণীয়

  • প্রকাশ সময় শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১
  • ৫৬১ বার দেখা হয়েছে

সুরভী বিশ্বাস, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ: “আমার যাওয়ার জায়গা থাকলে আমি মাইয়াডারে লইয়া বিয়ের রাতেই পালাইয়া যাইতাম”-বলছেন খুলনার করিমন বেগম(ছদ্মনাম), বাল্য বিয়ের শিকার এক কন্যা শিশুর মা। ছোট সরকারী চাকরীজীবী বাবা, মেয়ে নাজু(ছদ্মনাম), ১৩ বছর, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। মেয়ের নাজুর বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয় এক রিক্সাওয়ালা ছেলের সাথে, শোনা যায় রিক্সাওয়ালা হলে ও ছেলের নামে ব্যাংকে অনেক টাকা আছে। নাজু বার বার তার বাব-মাকে বোঝাতে থাকে, সে এখন বিয়েটা করতে চায় না।
যে দিন ছেলেপক্ষ নাজুকে দেখতে আসে নাজু গায়ে ও মুখে কেরোসিন ও কালি মেখে বসে থাকে, দুর্ভাগ্য, তারপর ও বিয়েটা ঠেকাতে পারেনি। মা করিমন চোখের জলে বুক ভাসান আর বলেন-“মারে তোরে নিয়া আমি কই যামু, তোর সাথে যে আমি ও চিরদিনের জন্য সংসার ছাড়া হবো, তোর আব্বা, চাচা, দাদী সবাই রাজী।” এমন করিমনের গল্প আছে আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে হাজার হাজার।

নারী হিসেবে নারীর অসহায়ত্বের আরও এমন গল্প আছে আমাদের চারপাশে। এক মা যেমন পারেনি তার কন্যা সন্তানকে বাল্য বিবাহের হাত থেকে রক্ষা করতে তেমনি চতুর্থবারের মতো কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়ায় পুকেেুর ফেলে ৮ দিন বয়সী শিশুকে হত্যা করেছে আরেক জন্মদাত্রী মা শ্যামলী ঘোষ (সুত্র -০৪ জুন, ২০২১ ভোরের কাগজ)। এই ‘মা’ নামের কলংক নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। সবার প্রশ্ন -কি করে সম্ভব একজন মায়ের পক্ষে এমন কাজ করা।
প্রতিবেদনের যে তথ্যটি আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে তা হলো , “শ্যামলী ঘোষ তিন কন্যা সন্তানের পর আবারও কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ায় স্বামীর সাথে তার ব্যাপক বিরোধ চলছিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে স্বামী মানিক ঘোষ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় অভাবের তাড়নায় শ্যামলী ঘোষ কন্যা শিশুটিকে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন।” উপরের দুটি গল্পেই দেখা গেল মা কখনো অপারগ আবার কখনো বা পরিস্থিতির বাস্তবতায় তার কণ্যা সন্তানের জন্য কাঙ্খিত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না ।

২০২০ সালের আগস্ট মাসে ব্র্যাক হিউম্যান রাইটস এন্ড লিগ্যাল এইড সার্ভিস এর একটা ফিল্ড এ্যাসেসমেন্ট এর প্রতিবেদন প্রকাশ করে । ২৯৮ টা উপজেলা লিগ্যাল ক্লিনিক থেকে সেবা গ্রহণ করেছে এমন নারীদেও সাথে কথা বলে তারা জানতে পাওে তাদের ৮২% ছিলো যাদেও ১৮ বছরের নীচে বিয়ে হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বাল্য বিবাহের যে চিত্র উঠে এসেছে তা সত্যিই ভয়াবহ। আবার কোভিড- ১৯ মহামারীতে বাল্য বিবাহ আরও বেড়েছে । ঢাকা ট্রিবিউিনের ০৪ জুন ২০২১ এ একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মহামারীর কারনে বিগত বছরে বাল্য বিবাহ বেড়েছে শতকরা ১৩ ভাগ।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ১৯ ধারায় বিশেষ পরিস্থিতিতে বাল্য বিবাহের অনুমতির সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে আবশ্যই আদালত এবং অভিভাবকের সম্মতি থাকতে হবে। আইনের এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে এই ধারার অপব্যবহার করছেন। আবার অনেকেই বুঝে বা না বুঝে আইন অমান্য করছেন যা বাল্য বিবাহের ঝুঁিককে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাল্য বিবাহ আমাদেও সামজের একটি বড় সমস্যা । এটি বন্ধে আমাদের স্ব স্ব জায়গা থেকে ভুমিকা পালণ করতে হবে। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এই সংকট দূর করতে পুরুষের ভুমিকা অনস্বীকার্য। এখনও পর্যন্ত পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পুরুষই নিয়ে থাকেন। কন্যা শিশুর জীবন, শিক্ষাগ্রহন এবং বিবাহ সম্পকিত সিদ্ধান্তের প্রায় সবটাই আসে বাবার কাছে থেকে। আর সব সময় বাল্য বিবাহগুলো হতে দেখা যায় ১৮ এর নীচে মেয়ের সাথে তার চেয়ে অনেক বেশি বয়সী পুরুষের সাথে। এখানে ও পুরুষের আনেক বড় ভুমিকা আছে বলে সবাই মনে করে।
নিচে এমন কিছু ভুমিকার কথা উল্লেখ করা হলোঃ
১. পারিবারিক সিদ্ধান্ত গুলোতে যিনি সিদ্ধান্তদাতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরুষই পরিবারের সর্বময় সিদ্ধান্তদাতা। তাকে অবশ্যই বাল্য বিবাহ বন্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। একই সাথে পরিবারে নারীর সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিতে হবে।
২. একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ নিজের জায়গায় যদি তার প্রতিশ্রæতি জোরদার করতে পারেন যে, উনি কোন আবস্থাতেই ১৮ নীচে মেয়েকে বিয়ে করবেন না, তাহলেই বাল্য বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে।
৩. আইনের শাসন জোরদার করার পাশাপাশি, বাল্য বিবাহের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তির চাকরী চ্যুতি বিষয়টি অনÍর্ভুক্তি করা ও জোরদার করা।
৪. নারীর ক্ষমতায়নের জন্য পুরুষকে অবশ্যই সহযোগী হিসাবে কাজ করতে হবে।
৫. নারীর প্রাপ্য অধিকার, সুযোগ ও সম্মান তাকে দিতে হবে।
৬. পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার দিতে হবে।

কণ্যা শিশুর প্রতি অবিচারসহ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও কাজ করছে । আমি উল্লেখ করতে চাই ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধ এবং পরিবারের নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মেন কেয়ার নামে একটি মডেল ব্যাবহার করছে যার মাধ্যমে পুরুষকে সম্পৃক্ত করা হয়। এতে করে শহর থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে পুরুষরা বুঝতে পারছে সমাজ পরিবর্তনে তাদের অংশগ্রহনের গুরুত্ব। পাশাপাশি শিশুদেরকেও আমরা নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছি । এই শিশুদল এবং ম্যানকেয়ার মডেলে অংশ নেয়া পুরুষরাই সমাজে চেঞ্জ এজেন্ট বা পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে ।

 

 

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো নিউজ দেখুন
© All rights reserved © 2021 dailysuprovatrajshahi.com
Developed by: MUN IT-01737779710
Tuhin