রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৯ পূর্বাহ্ন

সেজাস জুস কারখানায় আগুনে লাশ এতটাই পুড়েছে যে, চেনা মুশকিল

  • প্রকাশ সময় শুক্রবার, ৯ জুলাই, ২০২১
  • ১৬৭ বার দেখা হয়েছে

 

এস.আর.ডেস্ক: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেডের সেজান জুসের কারখানার চারপাশে এখন শুধু কান্নার আহাজারি। কেউ স্বজন হারিয়ে বিলাপ করছেন আবার কেউ স্বজনের খোঁজে। আগুনের শিখা নিভিয়ে ধ্বংসস্তূপে মানুষের খোঁজ করছেন উদ্ধারকর্মীরা। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। পুরোদমে চলছে উদ্ধার কাজ।

বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকাল ৫টায় ঘটনার পরপরই তিন জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। তারা আগুন থেকে বাঁচতে লাফিয়ে নিচে পড়ায় মারা যান। শুক্রবার (৯ জুলাই) সকাল থেকে একে একে বের করে আনা হয় ৫২টি লাশ। ছয়তলা এ ভবনের চারতলা পর্যন্ত উদ্ধার কাজ চালিয়ে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়। যদিও পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় এখনও উদ্ধার কাজ চালানো সম্ভব হয়নি।

আজ উদ্ধার হওয়া ৫২ জনের দেহ এতটাই পুড়েছে যে পরিবারের লোকেরা দেখে লাশগুলো চিহ্নিত করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন ফায়ার ব্রিগেডের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। তিনি জানান, আজ যেসব লাশ উদ্ধার হয়েছে তার প্রায় সবই এমনভাবে দগ্ধ যে সেগুলো আত্মীয়রা দেখে চিনতে পারছেন না। তাই এই লাশগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে ডিএনএ টেস্টের জন্য। টেস্টের মাধ্যমে লাশগুলো শনাক্ত করে আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, আগুন প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার পর নিচতলা থেকে চতুর্থতলা পর্যন্ত খোঁজ করে ৫২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠতলার আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এনে পুরো ভবনটিতে আমরা তল্লাশি চালাবো।

তিনি জানান, বেশিরভাগ লাশ চতুর্থতলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অনেকের লাশ সিঁড়িতেও পাওয়া যায়। সিঁড়িসহ অন্যান্য স্থানে বিপুল পরিমাণ ফয়েল পেপার, রাসায়নিক দ্রব্য, বিস্কুট-লজেন্স-কেক-জুস-নুডুলসের প্যাকেট মজুত ছিল। এগুলোর মাধ্যমে আগুন সিঁড়িতেও জ্বলছিল। ফলে চতুর্থ তলায় আটকে পড়া শ্রমিকরা ছাদে যেতে পারেননি এবং নিচেও নামতে পারেননি।

ফায়ার ব্রিগেডের এ পরিচালক বলেন, প্রতিটি ফ্লোরে জিআই তার দিয়ে নেটের মতো তৈরি করে রাখা হয়েছিল। এই নেটের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের আসা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এই আসা যাওয়ার জায়গাটি খুবই ছোট। ফলে ধোঁয়ায় যখন পুরো ভবনটি আচ্ছন্ন হয়ে যায় তখন হুড়োহুড়ি করে এ গেট দিয়ে বের হতে গিয়ে অনেকে আটকা পড়েন। ছয়-সাত হাজার শ্রমিক যে ভবনে কাজ করে সেখানে কমপক্ষে চারটি বড় আকারের সিঁড়ি থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে এ ভবনে সিঁড়ি ছিলো মাত্র দুইটি, তাও সরু। আবার এ সিঁড়ির এক পাশে বিভিন্ন পণ্য স্তূপাকারে রেখে দেওয়ায় এটি আরও সরু হয়ে গিয়েছিল।

প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক তাজুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম জানান, এ ভবনে লিফট থাকলেও তা ব্যবহারের অনুমতি ছিল শুধু কর্মকর্তাদের জন্য। যে কারণে ঘটনার সময়ও শ্রমিকরা লিফটে উঠতে পারেননি।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বলেন, কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে অনেক প্রাণ ঝরেছে। এ ঘটনায় যদি মালিক পক্ষের কোনও গাফিলতি পাওয়া যায়, অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। মালিক যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে এ বিষয়ে বিমানবন্দরসহ সব জায়গাতেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় এক বা একাধিক মামলা হবে। এ প্রতিষ্ঠানে যদি শিশু শ্রমিক নিয়োগের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে আলাদা আইনি ব্যবস্থা হবে। নিহতদের লাশ ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। সেখানে জেলা পুলিশের একটি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। যাতে নিহতদের স্বজনরা যোগাযোগ করে তাদের স্বজনকে শনাক্ত করতে পারে। যেসব মরদেহ শনাক্ত করা যাবে না, সিআইডি ক্রাইম সিনের মাধ্যমে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে সেগুলো শনাক্তের পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার দুই জায়গায় সিআইডি ও পিআইবির একাধিক টিম কাজ করছে।

কারখানাটির নাম হাসেম ফুড বেভারেজ হলেও এলাকাবাসী এটাকে সেজান জুসের কারখানা হিসেবে চেনেন। সেজান জুস মূলত পাকিস্তানের একটি পণ্য। হাসেম ফুডেরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সজীব করপোরেশন। বিদেশ থেকে কাঁচামাল এনে এখানে সেজান জুস তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করে আসছিল তারা। এ কারখানার ভেতরে জুসের পাশাপাশি নুডুলস, লাচ্ছি সেমাই, চকলেট, লাচ্ছি, কেক বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি ও প্যাকেটজাত করা হতো।

এই ভবনের নিচতলায় ছিল বিপুল পরিমাণ ফয়েল কাগজের কয়েল। বিপুল পরিমাণ কার্টন ও পরিত্যক্ত কাগজ। যেগুলো সিঁড়ির নিচে স্তূপ করা ছিল। নিচের ফ্লোরের পাশের একটি কক্ষে ছিল বড় আকৃতির একটি বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার। দ্বিতীয়তলায় শ্রমিকরা বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও প্যাকেটিংয়ের কাজ করতেন। তৃতীয়তলায় ছিলো দুটি হিট মেশিন। যেগুলো দিয়ে প্লাস্টিক গলিয়ে উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক তৈরি করা হতো। ভবনের চারতলার উত্তর দিকে ছিল বিশাল আকৃতির স্টোর রুম। এছাড়া ছয়তলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরেই ছিল দাহ্য পদার্থ ও বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থের মজুত।

প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক আবুল কাশেম জানান, নিচতলার সিঁড়ির পাশের কার্টনে আগুনের সূত্রপাত হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় ছড়ায়। যে কারণে দ্বিতীয়তলার শ্রমিকরা নিচে নামতে না পেরে ভবনের সামনের অংশের শাটার ভেঙে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়।

আগুন লাগার প্রায় ২২ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও বিশাল ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, আগুনে প্রতিটি ফ্লোরে মেশিনারিজসহ বিপুল পরিমাণ পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দ্বিতীয়তলার উত্তর পাশে বিকেল সাড়ে ৪টায়ও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তৃতীয়তলায়ও একই চিত্র দেখা যায়। তবে চতুর্থতলার চিত্রটি ছিলো সবচেয়ে ভয়াবহ। এখানে মানুষের শরীরের পোড়া অংশ, কোথাও পায়ের জুতা, স্যান্ডেল, মেয়েদের হ্যান্ড ব্যাগের পোড়া অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। শুক্রবার যাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয় তাদের বেশিরভাগকে এ ফ্লোর থেকেই উদ্ধার করা হয়।

আগুন নেভাতে ধীরগতির অভিযোগ তুলের সকাল সাড়ে ১০টায় হতাহত শ্রমিকদের আত্মীয় ও এলাকাবাসী প্রতিষ্ঠানের অদূরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কর্ণগোপ এলাকা লাঠিসোঁটা নিয়ে অবরোধ করে। এ সময় সাংবাদিকদের গাড়িসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাদের বাধা দিলে দুইপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। অবরোধকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট, পাথর, রাস্তার পাশে থাকা হকারদের চকি ভেঙে ছুড়তে থাকে।

অবরোধকারীদের একজন হাশেম ফুড বেভারেজের শ্রমিকের আত্মীয় আসলাম মিয়া জানান, তার বোনের মেয়ে লিনা এ কারখানায় কাজ করে। আগুনের পর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। লিনাসহ কারখানার আরও বেশ কয়েকজন শ্রমিকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন।

এদিকে, এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ২৫ হাজার ও আহতদের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া নিহতদের পরিবারের স্বজনদের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন রূপগঞ্জের স্থানীয় সংসদ সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি তদন্তের জন্য এখন পর্যন্ত তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো নিউজ দেখুন
© All rights reserved © 2021 dailysuprovatrajshahi.com
Developed by: MUN IT-01737779710
Tuhin