ধর্ম ডেস্ক : বিশ্ব মানবতার কল্যাণে ইসলাম ধর্ম হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। মানব কল্যাণের প্রত্যেকটি বিষয় এখানে গুরুত্বের সঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে; নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সঠিক পথের। তাই যেকোনো প্রয়োজনে ইসলামের বিধি-বিধান ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর আস্থা এ ধর্মের অনুসারীদের ওপর অবশ্য কর্তব্য। রক্তদান আধুনিক বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম এবং বর্তমান সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অপরিহার্য বিষয়। সুতরাং এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা সব অনুসারীদের জানা আবশ্যক।
ইসলামে রক্তের বিধান
রক্ত ছাড়া কেউ এক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে পারে না। শরীরে অভ্যন্তরে এর অবস্থান এবং যতক্ষণ তা শরীরের ভেতরে আছে তা পবিত্র। কিন্তু যখনই তা শরীরের বাইরে আসে তখন তা অপবিত্র। এটি কোনো ক্রমেই ভক্ষণযোগ্য নয়। কোরআন এটিকে হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ) করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শুকরের গোশত এবং যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। অবশ্যই যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানি ও সীমা লঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোনো পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান। ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৭৩; আরও দেখুন: সুরা মায়েদা : আয়াত ৩)
এসব আয়াতে রক্ত সম্পর্কিত দুটি বিষয় সুস্পষ্ট। এক. রক্ত হারাম বা নিষিদ্ধ (উল্লেখ্য, হারাম বস্তুর অন্যান্য ব্যবহারও সর্বসম্মতিক্রমে অবৈধ) এবং দুই. অনন্যোপায় হলে তা বৈধ। ইসলামের এই বিশেষ ব্যবস্থাপনায়ই তাকে অনন্য করে তুলেছে। ইসলাম সবসময়ই মানবতা এবং তার কল্যাণ ও প্রয়োজনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিশ্চিত করেছে।
রক্ত ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান
উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে শরিয়ত এ বিষয়ের বিধান নির্ধারণ করেছে। সর্বসম্মতিক্রমে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রক্ত ক্রয় কিংবা বিক্রয় করা হারাম (অবৈধ-নিষিদ্ধ)। তিনটি কারণ এর পেছনে রয়েছে। প্রথমত, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ অন্যান্য শারীরিক আনুষঙ্গিক জিনিসের পূর্ণ মালিকানা আল্লাহর। দ্বিতীয়ত, এটি অপবিত্র বস্তু। শরিয়তের বিধান হলো অপবিত্র এবং নিষিদ্ধ বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় কিংবা ব্যবসা সবই নিষিদ্ধ-অবৈধ। তৃতীয়ত, জীবননাশের হুমকিস্বরূপ। এটি ফলাফলগত কারণ। ইসলামী শরিয়তের পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্য রয়েছে। যাকে পরিভাষায় ‘মাকাসিদ আল-শরিয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ’ বলা হয়। তার মধ্যে প্রথম উদ্দেশ্য হলো ‘হিফজু আন-নাফস’ বা ‘জীবনের নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করা। রক্ত ক্রয় কিংবা বিক্রয় উভয়ই মানব জীবননাশের সম্ভাবনা তৈরি করে।
উল্লেখ্য, রক্তদাতা যদি বিনামূল্যে রক্ত দিতে না চান, তাহলে জরুরি পরিস্থিতিতে রোগীর কল্যাণের জন্য রক্ত ক্রয় করা বৈধ হবে কিন্তু বিক্রয়দাতার পাপ হবে। (বিস্তারিত- মুফতি মুহাম্মদ শফি, জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড ২, পৃ. ৩৮)
রক্তদান ও দাতার বিধান
শরিয়তের প্রত্যেকটি বিধান যেহেতু মানবতার জন্য, সৃষ্টির কল্যাণের জন্য সেহেতু এ বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কোনো কোনো অবৈধ (হারাম) বিষয়কে বৈধতা দিয়েছে শর্তসাপেক্ষে। ঠিক তদরূপ হলো রক্ত দান করার ব্যাপারটি। এটি যদি এমন পরিস্থিতিতে হয় যে, রক্তগ্রহীতার মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে এবং রক্তদাতার বিকল্প কোনো কিছুই করা সম্ভব না হলে স্বাভাবিকভাবেই রক্ত দেওয়া বৈধ। এ বৈধতার ব্যাপারে দুটি কারণ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
প্রথমত, রক্তগ্রহীতার জীবন রক্ষার চেষ্টা করা। এ ব্যাপারে কোরআনে সরাসরি বলেছে, ‘যে কোনো একজন ব্যক্তির জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করল।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৩২)।
দ্বিতীয়ত, অনন্যোপায় হওয়া। অর্থাৎ বিকল্প কোনো কিছু না পাওয়া। (দেখুন: সুরা বাকারা : আয়াত ১৭৩)
বিশেষ পরিস্থিতিতে রক্তদান বৈধ হওয়ার ব্যাপারে শরিয়ত বিশেষজ্ঞগণ যেসব যৌক্তিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন তা হলো-
এক. শরীরের অন্য আনুসঙ্গিক বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যেমন মায়ের দুধ। এটি শিশুর প্রয়োজনে যেমন ব্যবহারযোগ্য তেমনি রক্তও অন্যের জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরি। তাই এটি বৈধ।
দুই. এটিতে কাটা-ছেড়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বরং ইনজেকশনের মাধ্যমে ব্যথাহীনভাবে নেয়া যায়।
তিন. নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত দেওয়াতে ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, তিন মাসের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই রক্তের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। (বিস্তারিত দেখুন: মুফতি মুহাম্মদ শফি, জাওয়াহিরুল ফিকহ)
উল্লেখ্য, এটি অবশ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কর্তৃক নির্দেশিত হতে হবে এবং এ ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে, যেন রক্ত দেওয়ার কারণে রক্তদাতার জীবন হুমকির সম্মুখিন না হয়।
অমুসলিমদের রক্ত দেওয়া বা নেয়া
মুসলিমের জন্য অমুসলিমের রক্ত কিংবা অমুসলিমের জন্য কোনো মুসলিমের রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। অর্থাৎ উপরোল্লেখিত পরিস্থিতিতে একজন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম থেকে রক্ত নিতেও পারবেন, তাকে দিতেও পারবেন। (জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/৪০০)
যদিও মুশরিকদেরকে কোরআনে অপবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। (দেখুন: সুরা আল-মায়েদাহ, আয়াত ২৮) তবে, রক্তের প্রভাব অন্য দেহেও পড়ার সম্ভাবনা আছে, তাই মুসলিমের জন্য কোনো মুসলিমের রক্ত নেয়ার চেষ্টা করা উত্তম।
স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে রক্তদানের বিধান
স্বামীর রক্ত স্ত্রীর শরীরে, স্ত্রীর রক্ত স্বামীর শরীরে প্রবেশ করানো জায়েজ। তারা একে-অপরের জন্য অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের মতো। তারা একে-অন্যকে রক্ত দিলে বিয়ের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। বৈবাহিক সম্পর্কও যথারীতি বহাল থাকে।
ইসলামী শরিয়তের সূত্র মতে, মাহরামের সম্পর্ক দুধ পানের মাধ্যমে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বয়সের প্রয়োজন। আর দুধ পানের দ্বারা মাহরামের সম্পর্ক স্থাপনের বয়স আড়াই বছর। সুতরাং আড়াই বৎসর পর কোনো মহিলার দুধ পান করার দ্বারা যেমন মাহরাম সাব্যস্ত হয় না, তেমনি রক্ত নেয়া ও দেওয়ার মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর মাঝে মাহরামের সম্পর্ক তৈরি হয় না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪০)