রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:১৩ পূর্বাহ্ন

পবায় নেপিয়ার পাকচং ঘাস চাষে ঘটেছে বিপ্লব

  • প্রকাশ সময় শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৩
  • ৫৮ বার দেখা হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবিদক: ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ করা হয়। আর সেটিই বাংলাদেশের জন্য আর্শিবাদস্বরুপ হয়েছে। এখন গবাদি পশুতে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি গরুর মাংস রপ্তানি শুরু করেছে। এটি সম্ভব হয়েছে দেশে গবাদি পশুর খামারির সংখ্য পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়ার কারনে।

এদিকে রাজশাহীর পবা উপজেলায় খামারে বাণিজ্যিকভাবে বেড়েছে গরু পালন। উপজেলার নওহাটা পৌরসভা, বড়গাছি, হুজুরিপাড়া, পারিলা, হরিয়ান ও হড়গ্রাম ইউনিয়ন এলাকায় গরুর খামারি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। সেইসাথে উপজেলার খামারিদের গো-খাদ্য হিসেবে ঘাসের ব্যবহারও বেড়েছে। আগে বিলে আবাদি জমিতে ফসলের পাশে যে ঘাস হতো তা কেটে কৃষকেরা গরু-ছাগলের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে ঘাসের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। এই ঘাসের জাতের নাম হচ্ছে নেপিয়ার পাকচং। আর এই ঘাস চাষে খামারী ও কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন পবা উপজেলা প্রাণি সম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। পশুর খাদ্য নেপিয়ার পাকচং ঘাস চাষে ঘটেছে বিপ্লব। এতে যেমন একদিকে লাভবান হচ্ছে খামারী ও কৃষক। তেমনিভাবে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে গবাদিপশুর।

এই ঘাস থেকে গবাদিপশুর কাঁচা ঘাসের চাহিদা পূরণসহ ঘাস বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে অনেকে। এই ঘাস দেখতে আখের মতো লম্বা ৪ থেকে ১০ ফুট বা তার চেয়েও বেশি হয়। এ ঘাস দ্রুত বাড়ে, সহজে জন্মে, পুষ্টিকর, সহজপাচ্য ও খরাসহিষ্ণু। একবার রোপণ করলে ৪ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বৃষ্টি বা বর্ষার পানি জমে থাকে না এমন জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষ করা হয়। সব ধরনের মাটিতে এ ঘাস রোপণ করা হয়। তবে বেলে-দোআঁশ মাটি বেশি উপযোগী।

উপজেলার নেপিয়ার ঘাস চাষি বড়গাছি ইউনিয়নের সোহাগ ইসলাম বলেন, প্রথমে তিনি নিজের গবাদিপশুকে খাওয়ানোর জন্য ১০ কাঠা জমিতে ঘাস চাষ করেন। নিজের গবাদিপশুকে খাওয়ানোর পরে অতিরিক্ত ঘাস বিক্রয় করা শুরু করেন। এতে তার চাষের খরচ উঠে আসে বলে জানান তিনি। বিষয়টি তার নিকট লাভজনক মনে হওয়ায় তিনি নিজের জমি সহ লিজ নিয়ে ৫ বিঘা জমিতে নেপিয়ার জাতের ঘাস চাষ করেছেন। এই ঘাস বিক্রয় করে এখন অর্থনৈতিক ভাবে তিনি স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি এটাকে বর্তমানে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

নেপিয়ার ঘাস চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্ষার শুরুতে এ ঘাসের শিকড় বা চারা রোপণ করা হয়। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে প্রথম বৃষ্টির পর জমিতে চারা বা শিকড় লাগালে প্রথম বছরেই ৩-৪ বার পর্যন্ত ঘাস কাটা যায়। চারা বা শিকড় রোপনের পর যদি রোদ হয় বা মাটিতে রস কম থাকে তাহলে চারার গোড়ায় পানি দিতে হয়। এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব দুই-তিন ফুট এক চারা থেকে অন্য চারার দূরত্ব দেড় ফুট করে লাগাতে হয়। মাটিতে রস না থাকলে চারা লাগানোর পর পানি সেচ দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সাধারণত প্রতি একর জমি রোপণের জন্য সাত-আট হাজার চারা বা শিকড় এর প্রয়োজন হয়। ভালো ফলন ও গাছের বৃদ্ধির জন্য সার এবং পানি প্রয়োজন। বর্ষা মৌসুমে পানির প্রয়োজন না হলেও অন্য সময়ে পানির প্রয়োজন হয়। দেড় থেকে দুই টন গোবর প্রতি একরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়। গোবর সার না দিলে পরিমান মত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। বিশেষ করে ঘাস কাটার পর বিঘাপ্রতি ২০ কেজি ইউরিয়া ১০ কেজি পটাশ প্রয়োগ করলে এই ঘাস দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

নওহাটা পৌরসভার পুঠিয়াপাড়া গ্রামের গরুখামারী সাইফুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ধানের আউড়ের অনেক দাম তার পরেও ঠিক মত পাচ্ছি না। প্রতিনিয়ত দানাদার খাদ্যের দামও বাড়ছে। এসব কারণে খড়ের বিকল্প হিসেবে নিজের একবিঘা জমিতে নেপিয়ার জাতের ঘাস চাষ করে অল্প পরিমান আউড়ের সাথে মিশিয়ে গবাদিপশুকে খাওয়ায়। আর এই ঘাস খাওয়ানোর ফলে বাজারে গো খাদ্যের যেই দাম তা থেকে কিছুটা হলেও সাশ্রয় হয় আমাদের। আর এই ঘাসের সবচেয়ে সুবিধা হলো জমিতে এই ঘাস এক পাশে থেকে কাটতে শুরু করলে কয়েকদিনের ভিতরেই সেই পাশেই আবারো এই ঘাস জন্মায়। আর এই ঘাসের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক। তাই আমরা এই ঘাস লাগানো শুরু করি।

পবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. সুব্রত কুমার বলেন, উপজেলায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক গরু/ছাগল পালন কারী খামারী এই নেপিয়ার পাকচং ঘাস চাষের সাথে জড়িত। উপজেলার প্রায় শতাধিক একর জমিতে এই ঘাস চাষ হচ্ছে। ইতিমধ্যে “প্রাণী পুষ্টির উন্নয়নে উন্নত জাতের ঘাস চাষ সম্প্রসারণ ও লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রকল্প” এর আওতায় উপজেলার ৮ টি ইউনিয়নের ১৬ জন সুফলভোগীকে ঘাস চাষের জন্য প্রনোদনা হিসেবে বরাদ্ধকৃত দশ হাজার টাকার প্রথম কিস্তি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা করে প্রনোদনা দেওয়া হয়েছে।

পরবর্তীতে আরও পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করা হবে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে বিনামূল্যে এই ঘাসের কাটিং সরবরাহ করা হয়। এছাড়া উল্লেখিত প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়নে ২ জন করে মোট ৪৮ জন ঘাস চাষীকে সাইলেজ উৎপাদন, হে প্রস্তুতকরণ, সংরক্ষণে পরামর্শ এবং আরও উন্নত জাতের ঘাসের বীজ সরবরাহ করা হবে। এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নে ২০ জন করে মোট ১৬০ জন খামারীকে আধুনিক ঘাস চাষ সম্পর্কে প্রশিক্ষন প্রদান করা হবে। উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিস নেপিয়ার পাকচং জাতের ঘাস চাষে কৃষক ও খামারীদের নানা ভাবে সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে আসছে।

তিনি আরো বলেন, নেপিয়ার জাতের ঘাস মূলত থাইল্যান্ডে চাষ হয়। থাইল্যান্ড থেকেই এই ঘাস বাংলাদেশে দেশে এসেছে। উৎপাদন খরচ কম গবাদিপশুর জন্য পুষ্টিকর। একবার রোপন করলে ৪-৫ বছর ফলন পাওয়া যায়। উপজেলার সবথেকে বড় গরুর খামার “নাবা ক্যাটল” প্রায় একশত বিঘা জমিতে নেপিয়ার পাকচং জাতের ঘাস চাষ করছে। তাই উপজেলার কৃষক ও খামারিরা নিজেরাই ঘাস উৎপাদনে ঝুঁকেছেন। অন্যান্য আবাদের চেয়ে এখন ঘাস চাষে লাভ বেশি। উপজেলার সকল ইউনিয়নে কম বেশি ঘাস চাষ হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, বড়গাছি ইউনিয়ন, হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন, পারিলা ইউনিয়ন, হরিয়ান ইউনিয়ন, দামকুড়া ইউনিয়ন ও নওহাটা পৌরসভা সহ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় গরু খামারিদের কাছে এই ঘাসের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে নেপিয়ার ঘাস বিক্রয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বি হচ্ছে। ধানের আউড়ের অনেক দাম হওয়ায় বেশির ভাগ গরুর খামারিরা নেপিয়ার ঘাস দিয়ে গবাদিপশুর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করেছে।

তিনি বলেন, শুকনা আউড় ও খড়ের তুলনায় সবুজ ঘাসে প্রচুর ভিটামিন রয়েছে। গরুর খাবারের চাহিদা পূরণে এই ঘাস উপকারী। এই ঘাস পশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মাংস বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সুস্থ-সবল পশু পালনে সবুজ ঘাস হিসাবে নেপিয়ার জাতের ঘাসের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তারা নিজেদের জমিতে ঘাস চাষ করা ছাড়াও এলাকার অনেক ঘাস চাষীদের সাথে চুক্তিভিত্তিক ঘাস ক্রয় করছেন। এতে শুধুমাত্র এই নেপিয়ার ঘাস চাষকে কেন্দ্র করে অনেক চাষী স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে অন্য ফসলের তুলনায় অধিক লাভ করছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো নিউজ দেখুন
© All rights reserved © 2021 dailysuprovatrajshahi.com
Developed by: MUN IT-01737779710
Tuhin