নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মার পানি শুকিয়ে যখন চর পড়ে, তখন সেই চরে ফসলের আবাদ করেন দরিদ্র মানুষেরা। কিন্তু সেই মাটিই কেটে নিয়ে যাচ্ছে বালু কারবারিরা। ফসলসহ এ মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করায় মামলার খড়গ পড়েছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সেখেরপাড়া ও বারোমাইল-বিদিরপুর গ্রামের লোকজনের ওপর। বালুঘাট ইজারা গ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে আজাদ আলী নামের এক ব্যক্তি সম্প্রতি রাজশাহীর আদালতে গ্রামের ১০ জনের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলা করেন। আদালত আসামিদের কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠান। রোববার বিবাদীদের স্বশরীরে আদালতে হাজির হয়ে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
নোটিশ পেয়ে রোববার সকালে বিবাদীরা রাজশাহীর আদালতে এসেছিলেন। তবে তারা একা নন, তিন গ্রামের অন্তত চারশত মানুষ এ দিন তাদের সঙ্গে এসেছিলেন আদালত চত্বরে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করায় তারা এর প্রতিবাদ জানান। রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে তারা বিক্ষোভ করেন। পরে তারা প্রতিকার চেয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ এর নিকট একটি স্মারকলিপিও দেন।
জেলা প্রশাসনের ইজারা দেওয়া এই বালুমহালটি গোদাগাড়ী উপজেলার সেখেরপাড়া গ্রামে। বেশ কয়েকবছর ধরে এই ঘাটটি ইজারা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন। আগে সেখেরপাড়া ওয়াবদা মাঠে এলাকার ছেলেরা খেলাধুলা করত। কিন্তু এখন এই খেলার মাঠের ওপর দিয়েই বালুবাহী ট্রাক চলে। এলাকার যুবকেরা এখন আর ওই মাঠে খেলাধুলা করার সুযোগ পায় না। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা আজিজুল আলম বেন্টু, সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলী ও নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আনোয়ার হোসেন এই বালুমহালটি ইজারা নিয়েছেন। তাদের লোকজন গ্রামের পাশ থেকে মাটিও কেটে নিয়ে যাচ্ছেন অভিযোগ করে আগত গ্রামবাসী।
বিক্ষোভে এসেছিলেন এলাকার কলেজ শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবদুস সালাম। বালু কারবারিদের মামলায় তাকেও বিবাদী করা হয়েছে। আবদুস সালাম বলেন, ‘যেভাবে গ্রামের পাশ থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে তাতে কয়েকটি গ্রাম হুমকির মুখে পড়েছে। এলাকার মসজিদ, স্কুল থেকে শুরু করে সবই ভরামৌসুমে পদ্মায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তারা মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন। অভিযোগ করেছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নিকট। পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসে মাটি কাটা বন্ধ করেন। একদিন মাটি কাটা বন্ধ রেখে মাপজোখ করা হয়। ইজারা গ্রহণকারীরা কোনদিকে কতটুকু বালু ও মাটি কাটবেন তা তিনি দেখিয়ে দিয়ে যান। এরপরও তারা গ্রামের পাশ থেকে মাটি কাটতে শুরু করে। তখন বাধা দিলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।’
এই বিক্ষোভে প্রেমতলী-কাঁঠালবাড়িয়া, সেখেরপাড়া-বারোমাইল ও বিদিরপুর গ্রামের প্রায় চারশত জন নারী-পুরুষ আসেন। সেখেরপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকায় সরকারী বন রয়েছে। মাটি ও বালু কেটে নিয়ে যাওয়ার কারণে সামাজিক তারা সবকিছু রক্ষার জন্যই প্রতিবাদ করেছেন। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তারা সবাই এই কর্মকাণ্ডের এর প্রতিবাদ জানান। সেইসাথে অবিলম্বে এই মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান আগত গ্রামবাসী। তা না হলে গ্রামবাসী বড় আন্দোলন গড়ে তুলবে হুঁশিয়ারীদেন তারা। গ্রাম বাঁচাতে তাদের আর কাছে আর কোন পথ নেই।’
গ্রামের বাসিন্দা গোলাম কবির খোকন বলেন, ‘নদীর পানি নেমে যাওয়ার পর গ্রামের পাশে দরিদ্র লোকজন চাষাবাদ করেন। সেই জমিই ফসলসহ কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটার জন্য। এর ফলে গ্রামের লোকজন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা চাষাবাদ থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি গ্রামের পাশে গভীর খাদ তৈরি হচ্ছে। আসছে ভরামৌসুমে পানি এলেই ভাঙন শুরু হবে। এর ফলে কয়েকটি গ্রাম বিলিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই তারা চান তাদের গ্রামে যেন বালুমহাল করে ইজারা দেওয়া না হয়। এতে তাদের সন্তানেরা আবার খেলার মাঠে খেলবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চান গ্রামবাসী।
গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে জানতে চাইলে বালুমহাল ইজারা গ্রহণকারীদের একজন আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বালুমহালে বালুর পাশাপাশি মাটিও কাটতে পারব। সিডিউলে মাটি কাটার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে কোথাও কোন কাজই শতভাগ নিয়ম মেনে করা যায় না। এখানেও একটু এদিক-সেদিক হয়েছে। এখন গ্রামের কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি সুবিধা না পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলছে। গ্রামের লোকজন শহরে এসেছিলেন। তাদের মুরুব্বিরা তার সঙ্গেও দেখা করেছেন। আগামী ২২ তারিখে তাদের সঙ্গে আবার বসতে চেয়েছেন। বসেই সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন বলে জানান আনোয়ার হোসেন।