রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৯ পূর্বাহ্ন

চাকরি নেন ২০০৪ সালে, বিএড ডিগ্রী অর্জন ২০১১ সালে,বরখাস্ত হলেও প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন সুব্রত

  • প্রকাশ সময় সোমবার, ২৪ জুন, ২০২৪
  • ৫৬ বার দেখা হয়েছে

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী স্কুলটি তখন নিম্নমাধ্যমিক। নিম্নমাধ্যমিক স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদই নেই। অথচ প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদে ঐ পদেই চাকরি বাগিয়ে নেন সুব্রত কুমার কুন্ডু। আবার তখনকার জনবল কাঠামো অনুযায়ী, উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দিতে হলে প্রয়োজন ছিল বিএড সনদ। নিয়ম ভেঙে ২০০৪ সালে সুব্রত যখন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গায়েবি এ পদে যোগ দেন, তখন তার বিএড সনদই ছিল না। তিনি এ ডিগ্রী অর্জন করেন ২০১১ সালে।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার হাঁসমারী এম. উদ্দিন মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের এসব অনিয়ম এতদিন চাপা থাকলেও সম্প্রতি জানাজানি হয়েছে আরেক শিক্ষকের অভিযোগে। স্কুলটি ২০০৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় হয়। গত দেড় যুগে স্কুলটিতে বেশ কয়েকটি কমিটি দায়িত্ব পালন করলেও কোনো কমিটিই সুব্রত কুমার কুন্ডুর নিয়োগ জালিয়াতি নজরে আনেনি। বিষয়টি সর্বশেষ পরিচালনা কমিটির নজরে এলে এই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। তবে তিনি এখনও পদ ছাড়েননি। ক্ষমতার দাপটে তিনি এখনও সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে গত ১৩ জুন আদালতে মামলা করা হয়েছে।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৭ আগস্ট বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রবিউল করিম মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) সুব্রত কুমারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, বিএড সনদ ও ১০ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়াই সুব্রত সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেছেন। পরে গত ৯ এপ্রিল মাউশির সহকারী পরিচালক এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে নাটোর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এখনও তদন্তই শুরু করেননি।

এদিকে জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরে গত ১১ মার্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলামের যৌথ স্বাক্ষরে সুব্রত কুমার কুন্ডুকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এ চিঠিতে বলা হয়, সুব্রত কুমারের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, তিনি ২০০৪ সালের ২৬ অক্টোবর সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। কিন্তু তিনি বিএড ডিগ্রী অর্জন করেছেন ২০১১ সালে। নিয়োগকালীন সময়ে সুব্রত কুমারের কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না।

এমপিও শীট পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেখানেও সন্তোষজনক কাগজপত্র নেই। সুব্রত কুমার এ পর্যন্ত সহকারী প্রধান শিক্ষকের অষ্টম গ্রেড অর্জন করতে পারেননি। তিনি প্রতিমাসে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ বেতন-ভাতা হিসেবে উত্তোলন করেছেন। তাই তার পদটি কেন শূন্য ঘোষণা করা হবে না তা সাত কার্যদিবসের মধ্যে সুব্রতকে জানাতে বলা হয়। কিন্তু তিনি জবাব দেননি। এরপর তাকে আরেকটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তখনও তিনি কোন জবাব দেননি।

পরে গত ২ এপ্রিল তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে চিঠি দেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম। এতে বলা হয়, কাম্য যোগ্যতা না থাকা স্বত্ত্বেও সুব্রত কুমার অতিরিক্ত বেতন উত্তোলন করেছেন, যা দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই সমুদয় অর্থ তাকে সরকারি খাতে জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম থেকে তাকে বিরত থাকার জন্যও বলা হয়।

একই দিন সভাপতি সাইফুল ইসলাম এই শিক্ষককে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের জন্য রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাছে আরবিট্রেশন উপস্থাপনের আবেদন করেন। সমস্ত কাগজপত্র যাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শিক্ষা বোর্ডের। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন কার্যক্রম শুরু করেনি কর্তৃপক্ষ। অথচ সরকারী কোষাগারে ১২ হাজার টাকা ফি দিয়েই যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ আরবিট্রেশন আবেদন করে পরিচালনা কমিটি। অভিযোগ উঠেছে, এ আরবিট্রেশন আবেদন করার কারণে সুব্রত কুমার শিক্ষা বোর্ডে প্রভাব খাটিয়ে সভাপতি সাইফুল ইসলামকেই পদ থেকে সরিয়েছেন। এখন তার আবেদনের অগ্রগতি নেই।

স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্যরা জানান, গত ১১ এপ্রিল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম অবসরে যান। পরদিন জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক রবিউল করিমকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেয় পরিচালনা কমিটি। কিন্তু বরখাস্ত হওয়া সহকারী প্রধান শিক্ষক সুব্রত কুমার কুন্ডু তাকে দায়িত্ব পালন করছেন না। বরখাস্ত হয়েও তিনি স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসছেন। অনেকটা জোর করেই তিনি বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক নথিপত্রে স্বাক্ষর করছেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সুব্রত কুমার জোর করে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তার কাছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং পরিচালনা কমিটির সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রবিউল করিম বলেন, ‘আমাকে ম্যানেজিং কমিটি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু বরখাস্ত হওয়া শিক্ষক সুব্রত কুমার কুন্ডু আমাকে চেয়ারে বসতে দিচ্ছেন না। তিনি চেয়ার দখল করে আছেন। আমাকেই হুমকি দিচ্ছেন যেন আমি স্কুলে না যাই। ক্ষমতার দাপটে তিনি মাউশির তদন্ত আটকে রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে না। এ জন্য আমি বাদী হয়ে ১৩ জুন আদালতে মামলা দায়ের করেছি।’

জানতে চাইলে সুব্রত কুমার কুন্ডু বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাকালীন স্কুল হিসেবে পদ না থাকলেও আমি সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দিই স্কুলটি উচ্চ বিদ্যালয় হবে বলে। নিয়মকানুন মেনেই আমার নিয়োগ হয়েছে। পরে বিএড ডিগ্রী অর্জনের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, আমাকে কেউ বরখাস্ত করেনি। আমি কোন চিঠি পাইনি। তাই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সুব্রত কুমারের অনেক ক্ষমতা। বরখাস্তের পরেও তিনি অবৈধভাবে চাকরি করেছেন। অনিয়ম ধরা পড়ার পরে আমরা তাকে সাময়িক বরখাস্ত করি। এটির যেন আর অগ্রগতি না হয় তার জন্য তিনি শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রভাব খাটিয়ে আমাকেই সভাপতির পদ থেকে সরিয়েছেন। বোর্ড বলেছে, আমার নামে মামলা থাকার কারণে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার নামে কোন মামলাই নেই। একটি মামলা ছিল, সেটি বাদী আগেই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মহা. জিয়াউল হককে কয়েকদফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তাই এ বিষয়ে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো নিউজ দেখুন
© All rights reserved © 2021 dailysuprovatrajshahi.com
Developed by: MUN IT-01737779710
Tuhin