নিজস্ব প্রতিবেদক: জমির দাম হয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এরমধ্যে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন দুই ক্রেতা। বাকি রয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু দলিলে সার্বসাকূল্যে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। জমির বিক্রেতা চার্চ অব বাংলাদেশ বলছে, দলিলে যে দাম দেখানো হয়েছে ঐ দামেই জমি বিক্রি করা হয়েছে এবং সমস্ত টাকা তহবিলে জমা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্য ধরে দুই ক্রেতা সাড়ে ৬ কোটি টাকা পরিশোধ করলে বাকি প্রায় পৌনে ৬ কোটি টাকা কার পকেটে?
রাজশাহী নগরের প্রাণকেন্দ্র মালোপাড়ার এই জমি আইনবহির্ভুতভাবে চার্চ অব বাংলাদেশের নামে রেকর্ড করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার চার্চ অব বাংলাদেশ পরে সেই জমি পানিদরে বিক্রি করেছে। এ নিয়ে শনিবার জাতীয় একটি পত্রিকায় ‘হেমিলটনের জমি দুই নেতার দখলে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। বিকালে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে চার্চ অব বাংলাদেশ। তর্কিত ঐ জমিতে থাকা একটি ভবনেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন, চার্চ অব বাংলাদেশ পরিচালিত রাজশাহী খ্রীষ্টিয়ান মিশন হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ চাঁদ মণ্ডল। সাংবাদিকরা তাঁর কাছে জানতে চান, জমিটি বিক্রি করা হয়েছে কত টাকায়। জবাবে তিনি বলেন, ‘৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায় জমি বিক্রি করা হয়েছে। পুরো টাকাই চার্চ অব বাংলাদেশের তহবিলে জমা করা হয়েছে।’
অথচ গত ২৪ সেপ্টেম্বর জমির দুই ক্রেতার একজন মিজানুর রহমান বলেছেন, জমির দাম ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি টাকা তাঁরা দুজন পরিশোধ করেছেন। রাজস্ব ফাঁকি দিতে দলিলে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। জমি কিনতে সাড়ে ৬ কোটি টাকা দুজনে কীভাবে ম্যানেজ করেন সেটিও তিনি সেদিন বলেছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, জমির দুই ক্রেতার পরিশোধ করা সাড়ে ৬ কোটি টাকার মধ্যে তাহলে বাকি ৫ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা কোথায় গেল? জবাবে সংবাদ সম্মেলনে প্রদীপ চাঁদ মণ্ডল দাবি করেন, ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি একটি পয়সাও তারা নেননি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জমির ক্রেতা নগরের রাজপাড়া থানা বিএনপির আহ্বায়ক মিজানুর রহমানও। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনিও এ ব্যাপারে সদুত্তর দিতে পারেননি।
নগরের মালোপাড়া এলাকায় বোয়ালিয়া মৌজায় এই জমির পরিমাণ ছয় কাঠা। এরমধ্যে সাড়ে চার কাঠা দলিল করে দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ও মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদার নামে। শহরের প্রাণকেন্দ্রের মহামূল্যবান এই সাড়ে ৪ কাঠা জমি কেন মাত্র ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে, সে প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারেননি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজকেরা।
উল্লেখ্য, রাজশাহীতে দীর্ঘদিন এই জমিতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কার্যক্রম চলেছে। সিএস ও এসএ খতিয়ানে জমির মালিকের স্থানে লেখা আছে ‘মিস্টার হেমিলটন সাহেব, সাং- মহিষবাথান’। আরএস খতিয়ানে জমির মালিক হিসেবে লেখা আছে, ‘মিস্টার হেলীটন সাহেব, সাং- মহিষবাথান।’ ২০২০ সালে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য এই জমির কিছু অংশ সরকার অধিগ্রহণ করে। এই অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ঐ বছর ২৫ আগস্ট মিস্টার হেমিলটন সাহেবের মহিষবাথানের ঠিকানায় চিঠি ইস্যু করা হয়।
পরের বছরই ‘চার্চ অব বাংলাদেশ’ আরএস রেকর্ডে প্রজার নাম ভুল রয়েছে বলে সংশোধনের জন্য আবেদন করা হয়। তারা দাবি করে, হেমিলটন চার্চ অব বাংলাদেশের একজন তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। করণিকের ভুলে জমিটি তার নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। তারা জমিটি চার্চ অব বাংলাদেশের নামে রেকর্ড করে দেওয়ার আবেদন করে। এরপর ২০২১ সালের ১৫ মার্চ বড়কূঠি ভূমি অফিসের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল হায়াত জমিটির রেকর্ড সংশোধন করে দেন। জমিটির মালিকানা পেয়ে যায় চার্চ অব বাংলাদেশ। পরে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর চার্চ অব বাংলাদেশের পক্ষে সভাপতি রেভা. সুনীল মানখিন দুই বিএনপি নেতার কাছে ঐ জমি বিক্রি করে দেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর জমিটি দখলে নেন দুই নেতা।
এই জমি নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি হয়েছে দাবি করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা, রাজশাহীর সিটিকর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিনু সম্প্রতি আদালতে মামলা করেন। তিনি দাবি করছেন, ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই জমি ব্রিটিশ নাগরিক হেমিলটন সাহেবের নামে রেকর্ড রয়েছে। তিনি এখন নেই। তার কোন ওয়ারিশও নেই। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, এ জমি এখন সরকারের। কোনভাবেই চার্চ অব বাংলাদেশ মালিকানা পায় না। তারা এ জমি বিক্রিও করতে পারে না।
সংবাদ সম্মেলনে দেশের এই আইন নিয়েও সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন। কিন্তু আয়োজকেরা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। পর পর তিনটি খতিয়ানে করণিকের ভুলে কীভাবে জমির মালিক হিসেবে হেমিলটনের নাম থাকল, সে প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারেননি প্রদীপ চাঁদ মণ্ডল। রাজশাহী নগরের চণ্ডিপুর এলাকায় আরেকটি মূল্যবান জমি মাত্র ৬৪ লাখ টাকায় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানের কাছে বিক্রি করেছে চার্চ অব বাংলাদেশ। এই জমিটিও কেন একই ব্যক্তির কাছে পানিদরে বিক্রি করা হয়েছে সে প্রশ্নেরও সদুত্তর দেননি প্রদীপ চাঁদ মণ্ডল। সাংবাদিকদের বেশিরভাগ প্রশ্নের সদুত্তর না দিয়েই দ্রুত সংবাদ সম্মেলনটি শেষ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে চার্চ অব বাংলাদেশের জমিজমা সংক্রান্ত সেক্রেটারী প্রকৃতি বিশ^াস, সিনড ট্রেজারার বিনিময় বিশ^াস, রাজশাহী ডিনারীর (ডীন) অঞ্চল প্রধান রেভারেন্ড মিকায়েল সরেন, রেভারেন্ড সমুয়েল হেমব্রম, রেভারেন্ড তপন মণ্ডল, রাজশাহী ডিনারীর প্রপারটি ম্যানেজার ইফ্রইম হেমব্রম, সম্পাদক রাজু মার্ডি ও মহিষবাথান চার্চের সম্পাদক রিপন কিস্কু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।