নিজস্ব প্রতিবেদক: শিম একটি প্রোটিন সমৃদ্ধ জনপ্রিয় সবজি। শিমের বিচিও পুষ্টিকর সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। প্রতিটি ঘরে শীতকালে শিমের তরকারি রান্না হয়। শীতকালীন সবজি হিসেবে শিমের চাহিদাও ব্যাপক। এ অঞ্চলের মাটি সবজি চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় আগাম জাতের শিম চাষ করেন কৃষকরা। আগাম জাতের শিম চাষে ফলনও দ্বিগুণ। মৌসুমের আগে বাজারে শিম আসায় ক্রেতাদের কদরও বেশি হয়। আবার আগাম শিম চাষে ফলন ও দাম দুটোই তাঁরা ভালো পাচ্ছেন। এতে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। মৌসুমের শুরুতে শিমের বাজার মূল্য বেশি থাকায় শিমচাষিদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের ঝিলিক।
উপজেলার নওহাটা পৌরসভার পাকুড়িয়া, দামকুড়া ইউনিয়নের শীতলাই, হরিপুর ইউনিয়নের টেংরামারী, হুজুরীপাড়া ইউনিয়নের দারুশা, হরিয়ান ইউনিয়নের সুচরন, বড়গাছী ইউনিয়নের চন্দ্রপুকুর, ভালাম, পারিলা ইউনিয়নের মাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় শিম, লাউ, মুলা, বেগুন, শাকসহ নানা জাতের সবজি পরিচর্চায় ব্যস্ত কৃষকেরা। মাচায় শিমের গাছগুলোতে ভরে উঠেছে ফুল আর শিম। পথে-প্রান্তরে, বাড়ির উঠানে ও মাঠের জমিতে সুতো ও বাঁশের তৈরি মাচার উপর দুলছে শিম গাছের কচি ডগা।
শিম গাছের সবুজ পাতার কচি ডগায় উঁকি দিয়ে হাসছে সাদা ও বেগুনি রঙের ফুলে কৃষকের স্বপ্ন। ছড়ায় ছড়ায় ঝুলছে সবুজ শিমের সমারোহ। শিম গাছের ডগার ফুল ও শিমের থোকা পথচারীদেরও করছে মুগ্ধ। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে ভরে উঠেছে এলাকার খেত খামার। খেত থেকে প্রতিদিন শিম তোলার পর বাজারে পাইকারী ও খুচরা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে পাইকাররা হাট-বাজার থেকে শিম ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করছেন।
নওহাটা পৌরসভার পাকুড়িয়া এলাকার শিমচাষী রফিকুল ইসলাম জানান, ‘এবার প্রথম ১০ কাঠা জমিতে কার্তিকা জাতের শিম চাষ করেছেন। আগাম শিম চাষে ভালোভাবে খেতের পরিচর্যা করায় ফুল ও ফল ভালো হয়েছে। শিমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে সার বিষ প্রয়োগ করেছেন। আবহাওয়া ভাল থাকলে শিমের বাম্পার ফলন হবে, দামও ভালো পাওয়া যাবে আশা করছি।’
দামকুড়া ইউনিয়নের শীতলাই এলাকার শিমচাষি ওয়াজেদ আলী জানান, ‘আগেকার দিনে আমরা ভিটে বাড়িতে ও খেতের আইলে শিম লাগাতাম। বৃষ্টির পানি ও শিশিরে ফুল ভিজে শিমের গাছ পচে যেত। বর্তমানে শিমের উন্নত জাত উদ্ভাবনের কারণে পোকা ও রোগবালাই কম হয়। এখন সবজির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এক বিঘা জমিতে বারি-৪ জাতের শিম চাষ করেছেন। এই জাতের শিমের ফলন অন্য শিমের চেয়ে বেশি হয় তাই চাষ করেছি। ফুল ও ফল ভাল হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।’
হরিপুর ইউনিয়নের টেংরামারী এলাকার শিমচাষী আলামিন জানান, ‘আগাম গ্রীষ্মকালীন ইপসা-১ হাইব্রিড জাতের শিম ১০ কাঠা জমিতে চাষ করেছেন। রোপণের ৪৫ দিনের মধ্যে শিম গাছে ফুল ও ফল আসতে শুরু করেছে। প্রায় ৬০ দিন পর গাছ থেকে শিম উত্তোলন শুরু করেছেন। বীজ রোপণ, সেচ দেওয়া, সার প্রয়োগ, আগাছা দমন, কীটনাশক ও মাচা তৈরিসহ মোট ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা শিম বিক্রয় করতে পারবো।’
উপজেলার খড়খড়ি হাটের পাইকারী সবজী ব্যবসায়ী আড়তদার মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘শিম মৌসুমের নতুন সবজি এখনও পুরোপুরি বাজারে আসতে শুরু করেনি। শুরুর দিকে চাহিদা একটু বেশি হয়, দামও বেশি থাকে লাভও হয়। স্থানভেদে পাইকারি প্রতি কেজি শিমের দাম ১২০-১৩০ টাকা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন শহরে শিম পাঠানো হচ্ছে।’
মতিয়াবিলের সবজী ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী বলেন, ‘প্রতি কেজি শিম বিক্রয় হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকা কেজি দরে। তবে স্থানভেদে বাজারে প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকায়।’
উপজেলার আলিমগঞ্জ ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যতিক্রমধর্মী ফসল নিয়ে কাজ করে থাকি এবং কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। কম খরচ ও কম পরিশ্রমে শিম উৎপাদন বেশি হওয়ায় লাভবান হচ্ছে চাষিরা। স্থানীয় কৃষকরা বিভিন্ন জাতের শিম চাষ করে। শীতকালে শিমের ভালো ফলন হয় তবে এখন বারোমাস শিম চাষ হচ্ছে। কৃষকরা যাতে উৎপাদন বেশি করতে পারে আবার ন্যায্য মূল্য পায় সেজন্য মাঠ পর্যায়ে তাদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও সহযোগিতায় কাজ করছি।’
নওহাটা পৌরসভা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন দেওয়ান বলেন, ‘শিম ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের প্যাচ ছড়ানোর জন্য নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে ও সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও শিমের বিছাপোকা এবং মোজাইক ভাইরাস দমনে কৃষকদের নিয়ম মেনে যুক্তি সংগত বালাইনাশক প্রয়োগের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে শিমের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। রোপণের ৪৫ দিন পর আশ্বিন–কার্তিক মাসে গাছে ফুল ও ফল আসে এবং ৪ মাসেরও অধিক সময় শিম ধরে। দো-আঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি শিম চাষের জন্য উত্তম হলেও সব ধরনের মাটিতে শিম চাষ করা যায়।
শিম জমি ছাড়াও রাস্তার ধারে, জমির আইলে, ঘরের চালে, পুকুরের পাড়, গাছেও ফলানো যায়। শিম শুকিয়ে হলদে হলে বীজ হিসাবে সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে হয়। দেশে পঞ্চাশটিরও বেশি স্থানীয় জাতের শিম চাষ হয় এছাড়াও আধুনিক উচ্চ ফলনশীল জাতও আছে। স্থানভেদে বারি-১, বারি-২, বারি-৩, বারি-৪, ইপসা-১, কার্তিকা, বারমাসি প্রভৃতি জাতের শিমের চাষ হয়। এলাকায় এখন বাণিজ্যকভাবে শিম চাষ হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় কম খরচে বেশি ফসল ও ভালো লাভ হওয়ায় অনেকেই আগাম জাতের শিম চাষ করছে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসনিম বলেন, ‘উপজেলার ১০৫ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। শিম শীতকালীন সবজি হলেও বারোমাস চাষ করা যায়। বর্তমানে আগাম হাইব্রিড শিম চাষ করে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। আগাম জাতের শিম চাষে কৃষকেরা দাম ভালো পাওয়ায় দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে। মাঠ পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা ধরনের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করাসহ পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা করছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর শিমের ভালো ফলন হবে আশা করছি। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সব ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রণোদনা দিয়ে তাদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করতে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ কারণেই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান ও সফল হচ্ছেন।’