নিজস্ব প্রতিবেদক: মাঠজুড়ে সোনালী ধান। কারও কারও উঠোন ভরে উঠেছে নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামের এমন এক উঠোনেই শনিবার বিকালে হয়ে গেল বাঙালির ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব। তার আগে গ্রামের মাঠে ধান কাটার প্রতিযোগিতায় নামলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নারীরা।
তারপর ছিল নাচ-গান, খেলাধুলা এবং তার ফাঁকে ফাঁকে অতিথিদের বক্তব্য। প্রতিবছরই এ গ্রামে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। বাংলার আবহমান এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক মনিরুজ্জামান মনির ছয়বছর ধরেই আয়োজন করছেন নবান্ন উৎসবের।
এবারও গ্রামের সবাইকে নিয়ে তিনিই আয়োজন করেন এই উৎসবের। এ দিন গ্রামজুড়ে খুশির বন্যা বয়ে যায়। এবারও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই গ্রামের মানুষের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখা যায়। গ্রামের এ উৎসবের দিন কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে ভাল খাবার হয়। এবারও সকাল সকাল বাড়ির কাজ সেরে বিকাল ৪টার মধ্যে সবাই চলে আসেন মাঠে।
শুরুতেই পরনে নতুন শাড়ি পরে কাস্তে হাতে ধান খেতে নামেন ৯ নারী। খেতের পাশে সারা গাঁয়ের মানুষ, বাইরে থেকে অতিথিও এসেছেন। সবার চোখ মামনি তির্কি, চম্পা খা খা, ঝিনুক মালাদের দিকে। জাতীয় সংগীতের পর ধান কাটার উদ্বোধন করে দিলেন অতিথিরা। তারপর ৯ নারী চোখের পলকেই কেটে সাবাড় করলেন প্রায় পাঁচ কাঠা জমির ধান।
শুরুতেই ধান কাটার প্রতিযোগিতায় নামেন ফর্সাপাড়া গ্রামের রেখা কুজুর, স্বপ্ন লাকড়া, উরিনা লাকড়া; কান্তপাশা গ্রামের সুচি মিনজ, রোজিনা টপ্প্য, মামনি তির্কি এবং ফর্সাপাড়া গ্রামের বিমলা বেগ, ঝিনুক মালা ও চম্পা খা খা’র দল। সবার আগে নিজেদের সারির ধান কেটে প্রথম হয় ফর্সাপাড়া গ্রামের রেখা কুজুরের দল।
প্রতিযোগিতায় নেমে তিনজনের প্রতিটি দলকে লম্বালম্বি ২১ গোছা ও চওড়ায় ১৪ গোছা ধান কাটতে হয়। মোট ধানের গোছা হয় ২৯৪টি। রেখা কুজুরের দল ১০ মিনিট ১২ সেকেন্ডে সব ধান কেটে শেষ করে। দ্বিতীয় হওয়া কান্তপাশা গ্রামের দলটি সময় নেয় ১০ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড। আর তৃতীয় হওয়া ফর্সাপাড়া গ্রামের অপর দলটি সময় নেয় ১১ মিনিট।
গ্রামে এ প্রতিযোগিতা হচ্ছে ছয় বছর ধরে। গত তিনবছর প্রথম হয়েছে ফর্সাপাড়া গ্রামের রেখা কুজুরের দল। এবারও তারা প্রথম। অনুষ্ঠান শেষে প্রথম হওয়া তিন নারীকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় শাড়ি। অন্য দুই দলের ছয় নারী পুরস্কার হিসেবে পান একটি করে গামছা।
কৃষিক্ষেত্রে ভাল অবদান রয়েছে এমন ব্যক্তিকে প্রতিবছরই এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আনা হয়। এবার এসেছিলেন রাজশাহীর তানোরের স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী ও জাতীয় কৃষি পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ; অসহায় মানুষকে বিনামূল্যে ভেষজ চিকিৎসা দেওয়া বগুড়ার কাহালুর আবদুল কাদের খান এবং নওগাঁর শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর আলম শাহ। ছিলেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে ছালমা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহীর ঊর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম খাতুন এবং সাংবাদিক আবু সালেহ মো. ফাত্তা। অনুষ্ঠানে ফুলের মালা পরিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিশোরীরা অতিথিদের বরণ করে নেন।
অনুষ্ঠানে স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এই নবান্ন উৎসব কৃষকের সারাবছরের ক্লান্তি দূর করে দেয়। এমন আয়োজন এখন কমে গেলেও চৈতন্যপুর গ্রামে নতুন মাত্রা পেয়েছে কৃষক মনিরের কারণে।’ অনুষ্ঠানে বগুড়ার কাহালুর ভেষজ চিকিৎসক আবদুল কাদের খান বললেন, তিনি জীবনে প্রথমবার এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। সবার কাছে তার একটাই বার্তা, সপ্তাহের সাতদিনে অন্তত ১৪ ধরনের সবজি খেতে হবে। তাহলেই সবাই সুস্থ থাকবেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, ‘নবান্ন উৎসব আমাদের কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে মিশে আছে। একসময় আমরা কার্তিককে মরা কার্তিক হিসেবে জানতাম। সেই মরা কার্তিক এখন আর নেই। কার্তিক শেষ, অগ্রহায়ণের শুরু এই সময়ে নতুন আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষকের ঘরে ঘরে আমন ধান উঠছে। এই সময়ে নবান্নের উৎসব আমরা খুব উপভোগ করি। কাজেই এই ধরনের অনুষ্ঠানকে আমরা সাধুবাদ জানাই।’
উৎসবের আয়োজক মনিরুজ্জামান মনিরের বাড়ি রাজশাহী নগরের মহিষবাথান এলাকায়। উচ্চশিক্ষিত এই কৃষক চৈতন্যপুর গ্রামে চাষাবাদে নামেন প্রায় এক যুগ আগে। ফল-ফসল চাষের মাধ্যমে কৃষিতে বৈচিত্র্য এনে তিনি সফলতা পেয়েছেন। স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাই গ্রামের মানুষকে বছরের একটা দিন একটু আনন্দ দিতেই এ আয়োজন করছেন বলে জানালেন।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি যে, একজন কৃষক সারাবছরই সমস্যায় থাকেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চাষাবাদ করেও তারা ভাল লাভ করতে পারেন না। তাদের প্রতিকূল সময়ের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। তাই বছরের একটা দিন নির্মল আনন্দ দিতেই আমি এ আয়োজন করছি।’