রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৫:৪৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ

ফৌজদারি মামলার আসামিকে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসালেন ইউএনও

  • প্রকাশ সময় রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ৫৪ বার দেখা হয়েছে

 

# ইউএনওর গঠন করা কমিটির অডিটেই ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাতের চিত্র
# অর্থ আত্মসাতের ব্যবস্থা না নিয়ে সাময়িক বরখাস্ত অধ্যক্ষকে স্বপদে বহাল
# কার্যবিবরণীতে শুধু সভাপতির স্বাক্ষর, অন্য কেউ স্বাক্ষর করেননি

নিজস্ব প্রতিবেদক:একক ক্ষমতায় রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের সাময়িক বরখাস্ত অধ্যক্ষ সেলীম রেজাকে স্বপদে বহাল করেছেন গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। অথচ সেলীম রেজা অন্তত পাঁচটি মামলার আসামি। ফৌজদারি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্রও গৃহীত হয়েছে।

ইউএনও রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গতবছর ইউএনও এই কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিট করান। এতে উঠে আসে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন সেলীম রেজা। অথচ এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ না নিয়ে সেলীম রেজাকে স্বপদে বসান ইউএনও। এ নিয়ে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
সেলীম রেজা আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক। তবে ২০২২ সালের জুলাইয়ে এলাকার তৎকালীন সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তাঁকে বেদম পিটিয়েছিলেন। তখন দেশব্যাপী আলোচনায় এসেছিলেন সেলীম রেজা। মার খেয়েও তিনি তখন বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন। তবে এখন তিনি বলছেন, ওমর ফারুক চৌধুরী তাকে ঠিকই পিটিয়েছিলেন।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষকদের বেতনের টাকায় ভাগ বসানো, নিয়োগ বাণিজ্যসহ কলেজের আয়ের বিপুল টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে সেলীম রেজার বিরুদ্ধে। আওয়ামী সরকারের আমলেই তার বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়। কিন্তু এরপর ১৮ মাসেও তাকে বরখাস্ত করা হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে তিনি আর কলেজে যাননি। পরে ৫ আগস্ট থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ছুটি দেখান।
এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (মাউশি) তদন্ত করে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অনিয়মের সত্যতা পায়। তাই গত বছরের মার্চ থেকে তাঁর বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ২২ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষ সেলীম রেজা কলেজে ফিরলে ৫ নভেম্বর কলেজের ৩২ জন শিক্ষক তাকে বরখাস্তের জন্য কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ও ইউএনও আবুল হায়াতের কাছে আবেদন করেন। তখন ইউএনও আবুল হায়াত তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। আর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয় কলেজের শিক্ষক হাসিনা পারভীনকে। পরে কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিটের জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি করে দেন ইউএনও আবুল হায়াত।

এই কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন সহকারী অধ্যাপক নিরেন্দ্রনাথ সাহা। অন্য ছয় সদস্য হলেন- সহকারী অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, আব্দুস সবুর, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক সুলতানুল ইসলাম, প্রভাষক শামীম হোসেন, আব্দুস সামাদ ও প্রদর্শক আশরাফুল ইসলাম। গত ১৫ ডিসেম্বর এই কমিটি প্রতিবেদন দেয় যে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন অধ্যক্ষ সেলীম রেজা।

এদিকে স্বপদে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সেলীম রেজা। তিনি স্বপদে ফেরার জন্য গভর্নিং বডির সভাপতি ও ইউএনও আবুল হায়াতের কাছে সম্প্রতি আবেদন করেন। ইউএনও এ ব্যাপারে গত ২৮ জানুয়ারি তাঁর কার্যালয়ে গভর্নিং বডির সভা ডাকেন। সভাপতির ডাকে সেখানে যান গভর্নিং বডির সদস্য সচিব হাসিনা পারভীন, শিক্ষক প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য নুমায়ন আলী সেখানে যান।
ওই সভায় ইউএনও সেলীম রেজাকে স্বপদে বহাল করার প্রস্তাব দেন। এ সময় কমিটির অন্য তিন সদস্য এর বিরোধীতা করেন। কিন্তু তারপরও ইউএনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন এবং একটি কার্যবিবরণী তৈরি করে একাই স্বাক্ষর করেন। কার্যবিবরণীতে অন্য কেউ স্বাক্ষর করেননি। ইউএনও গায়ের জোরে সেলীমকে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসিয়েছেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।

গভর্নিং বডির সদস্য সচিব হাসিনা পারভীন বলেন, ‘ইউএনও সেলীম রেজাকে বহাল করার প্রস্তাব দিলে আমি বলি যে ৩২ জন শিক্ষক তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার আবেদন করেছিলেন এখন তাদের কি হবে? সেলীম রেজা তো ফিরেই প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করবেন। কিন্তু ইউএনও কথা না শুনে বললেন তাকে স্বপদে ফেরানোর জন্য দলীয় অনেক চাপ আসছে। ওপর থেকে সুপারিশ আসছে। ইউএনও নিজেই বললেন, সেলীম রেজার স্ত্রী নাকি তার বাসায় চলে যাচ্ছেন। এখন শুনছি যে, সেলীম রেজার বাড়ি পাবনার বেড়া উপজেলায়। ইউএনও এর বাড়িও পাবনার সাঁথিয়ায়। পাশাপাশি এলাকা। আত্মীয়-স্বজন দিয়েও নাকি ইউএনওকে ধরা হয়েছে। দুজনেই আওয়ামীপন্থী মানুষ। কেন তিনি এটা করলেন জানি না।’

হাসিনা বলেন, ‘গভর্নিং বডি চার সদস্যের। আমরা তিনজন কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করিনি। সভাপতি হিসেবে ইউএনও একাই স্বাক্ষর করেছেন। একক কারও স্বাক্ষরে তো কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। তাই ইউএনওর তৈরি করা কার্যবিবরণী অবশ্যই অবৈধ। আমরা এটি মানি না।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ইউএনও আবুল হায়াতকে কয়েকদফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। ইউএনওর স্বাক্ষর করা কার্যবিবরণীতে লেখা হয়েছে, কলেজের আরও কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে। মামলার কারণে অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হলে অন্যদেরও বরখাস্ত করতে হবে। এতে কলেজের পাঠদান ব্যহত হবে। তাই মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই বরখাস্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন ইউএনও।

যদিও ইউএনওর এমন সিদ্ধান্তকে স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবেই দেখছেন কলেজের শিক্ষকেরা। এমন স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শিক্ষক হাসিনা পারভীন গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে চারদিনেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য নুমায়ন আলী। তারা বলেন, সভাপতি হিসেবে ইউএনও একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন, এটা হতে পারে না।

অধ্যক্ষ সেলীম রেজা তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। অডিট রিপোর্টে ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, এই রিপোর্টও যথাযথ নয়। তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হলে গভর্নিং বডি একান্ত প্রয়োজন মনে করলে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে- এমন বিধান আছে। সভাপতি একান্ত প্রয়োজন মনে করেননি বলে তাকে বহাল করেছেন।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো নিউজ দেখুন
© All rights reserved © 2021 dailysuprovatrajshahi.com
Developed by: MUN IT-01737779710
Tuhin