শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০১:০৩ অপরাহ্ন

মেয়ের হাড্ডিগুলা দেন, ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাই’ এমন করুন আকুতি অসহায় এক বাবার

  • প্রকাশ সময় শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১
  • ১৭৫ বার দেখা হয়েছে

 

এস.আর.ডেস্ক: ‘আগুনে পুইড়া তো কয়লা হয়ে গেছে। মেয়ের হাড়-হাড্ডি যা আছে দেন, ওর মায়ের কাছে নিয়া দেই। হাড়-হাড্ডি পাইলেও তো ওর মা একটু সান্ত্বনা পাবো। যা ব্যবস্থা করার দ্রুত করেন’— কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন আকুতি জানাচ্ছিলেন এক বাবা। তার তিন সন্তানের একজন নুসরাত জাহান টুকি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন। ২৪ বছরের নুসরাত ওই প্রতিষ্ঠানে সহকারী সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

নুসরাতের বাবা হাসানুজ্জামান জানান, তার মেয়ে রাজশাহী মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ফুড অ্যান্ড বেভারেজে পড়াশোনা করেছে। এরপর বিএসসি করতে চেয়েছিল সে। এরমধ্যে হাসেম ফুড থেকে চাকরির অফার পেয়ে গত ৭ মার্চ এখানে যোগদান করে। বৃহস্পতিবার নুসরাতের এক সহকর্মীর কাছে আগুনের খবর পান তিনি। এরপর মেয়ের মোবাইলে অসংখ্যবার কল করেছেন কিন্তু কেউ ধরেনি। এক পর্যায়ে মোবাইল ফোনটিও বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউনের কারণে শুক্রবার পুলিশের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। শনিবার (১০ জুলাই) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডির কাছে মেয়ের মৃতদেহ শনাক্তের জন্য ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন।

শনিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে আসছেন স্বজনরা। স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এদিন বিকাল পর্যন্ত সিআইডির ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাব ১৮টি মৃতদেহের বিপরীতে ২৫ জন স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করেছে। সব মিলিয়ে ৩৭টি মৃতদেহের বিপরীতে ৫১ জন স্বজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

ডিএনএ নমুনা দেওয়া শেষে নুসরাতের বাবা হাসানুজ্জামান বলেন, ‘কথা বলে কী হবে? কিছুই তো হবে না। আপনারা শুধু আমার মেয়েটাকে দ্রুত শনাক্ত করে দেন। আমার মেয়েটার হাড়-হাড্ডি দেন। আমি যেন তার মায়ের কাছে নিয়া দিতে পারি। তার মারে যেন সান্ত্বনা দিতে পারি। যেন বলতে পারি মেয়েকে জীবিত আনতে পারি নাই, কিন্তু হাড়-হাড্ডি আনছি। এগুলো যেন যত্ন করে দাফন করতে পারি।’

শনিবার বিকালে মা নাজমা বেগমের খোঁজে স্বজনদের সঙ্গে মর্গে এসেছিলেন ১৩ বছরের নাজমুল হক। বছরখানেক আগে মা-ছেলে একসঙ্গে হাসেম ফুড লিমিটেডে কাজে ঢোকেন। মা নাজমা বেগম কাজ করতেন চতুর্থ তলায়, আর ছেলে নাজমুল দ্বিতীয় তলায়। বাবা অন্যত্র থাকেন, তাই মা-ছেলের রোজগারেই চলতো তাদের সংসার। ছোট্ট একটা বোন আছে তার।

সিআইডির কাছে ডিএনএ নমুনা দেওয়ার পর নাজমুল জানান, ঘটনার দিন বিকেল ৪টায় তার ডিউটি শেষ হয়। তিনি কারখানা থেকে বেরিয়ে যান। মায়ের ওভারটাইম চলছিল। তার বের হওয়ার কথা ছিল আটটায়। আটটার সময় কারখানার সামনে এসে মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তার আগেই ভয়াবহ আগুন। মায়ের ফোনে একাধিকবার কল দিয়েছেন কিন্তু ধরেনি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাজমুল বলেন, ‘আগুনের ঘটনা শুনে দৌড়ে কারখানার সামনে গিয়ে দেখি দাউদাউ কইরা জ্বলতাছে। কি করুম কিচ্ছু করার ছিল না। চোখের সামনেই হয়তো ভিতরে মায়ে আমার পুইড়া মরছে। এখন আমগো কী হইবো? কে দেখবো আমার ছোট বোনরে?’ বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। নাজমুলের সঙ্গে ছিলেন মামা ফারুক। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই তার মুখেও।

সরেজমিন শনিবার দুপুর থেকে বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে আগুনে পোড়া মৃতদেহগুলো থেকে পচা গন্ধ পাওয়া যায়। মর্গে ঢুকতেই পাশাপাশি দুটি কক্ষে ব্যাগের ভেতরে সারি করে রাখা ছিল মৃতদেহগুলো। স্বজনরা এভাবে লাশ পচে দুর্গন্ধ ছড়ানোয় তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন।

মেয়ে নুসরাতের খোঁজে আসা বাবা হাসানুজ্জামান বলেন, লাশগুলা একটু ফ্রিজেও রাখে নাই। দুর্গন্ধ ছড়াইতেছে। এইটা কেমন ব্যবস্থা? লাশগুলারে তো একটু সম্মানের সঙ্গে রাখা যাইতো। মেয়ে নাই, তার পোড়া হাড্ডিগুলারে আমাদের কাছে দিয়া দেন। আমরা যত্ন কইরা নিয়া যাবো। মেয়ে তো আমার। আমি এর কষ্ট বুঝতেছি।

ঢামেক হাসপাতালের মর্গের সহকারী সেকেন্দার জানান, এখানকার মর্গের লাশ রাখা ফ্রিজে এত মৃতদেহ রাখার জায়গা নেই। তাই ১৫টি মৃতদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গের ফ্রিজে রাখার জন্য পাঠানো হয়েছে। ৮টি ডেড বডি রাখা হয়েছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফ্রিজে। একটি কেবিনে একাধিক লাশ রেখে ফ্রিজিং করা হচ্ছে।

হাসেম ফুড লিমিটেডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে মোট ৫০টি মৃতদেহ রাখা ছিল। এর মধ্যে ৪৯টি পোড়া লাশ নিয়ে আসে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। এগুলো ডিএনএ নমুনা ছাড়া শনাক্ত করার উপায় নেই। মোরছালিন নামে তের বছর বয়সী এক কিশোর অগ্নিকাণ্ডের পর তিন তলা থেকে লাফিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন মধ্যরাতেই মারা যান তিনি। শনিবার বিকেল ৩টার দিকে মোরছালিনের লাশ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোরছালিনের পরিবারকে দাফন খরচ হিসেবে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

মোরছালিনের মামা জুয়েল হক জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে। অভাবের সংসারের কারণে ভাগিনা মোরছালিনকে তিনি রূপগঞ্জে এনে কাজে ঢুকিয়েছিলেন। তিনি নিজেও ওই কারখানায় কাজ করতেন। বৃহস্পতিবার তার রাত্রিকালীন দায়িত্ব ছিল। এজন্য তিনি আগুনের কবলে পড়েননি। ভাগিনা তিন তলায় কাজ করতো। আগুন লাগার পর সে বাঁচার জন্য তিন তলা থেকে লাফ দিয়েছিল। কিন্তু বাঁচতে পারেনি।

জুয়েল বলেন, ‘দুই ভাইবোনের মধ্যে মোরছালিন ছিল বড়। অভাবের কারণে এসএসসির পর আর পড়তে পারেনি। বাবা আনিসুর রহমান গরীব কৃষক। মোরছালীনের বেতনের টাকায় পরিবারটা কোনওভাবে চলতো। এখন তো তাদের আরও পথে বসার অবস্থা। আমরা নিহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানাই।’

এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুক্রবারই আগুনের ঘটনায় নিহত দুই জনের লাশ রূপগঞ্জ থেকেই তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো নিউজ দেখুন
© All rights reserved © 2021 dailysuprovatrajshahi.com
Developed by: MUN IT-01737779710
Tuhin