নিজস্ব প্রতিবেদক: পশু পাখি দেশের ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গ্রামের মানুষদের বিভিন্ন পাখির কলতানে সকালের ঘুম ভাঙ্গে। এছাড়াও পাখি কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। এছাড়াও পাখির পুরিষের মাধ্যমে বিভিন্ন গাছের বিচি মাটিতে পরে জন্ম হয় জঙ্গল। আর একটি দেশের ভারসসাম্য রক্ষা করতে হলে সর্বনি¤œ ২৫ভাগ বন থাকতে হয়। সেখানে বাংলাদেশে ১০ভাগের বেশী নেই। এই বাস্তবতায় উন্নয়নের নামে বনভূমি উজার করা হচ্ছে। সাথে পশু পাখির আবাস্থলও বিনষ্ট করা হচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে একযুগ পূর্বেও বহু বড় বড় গাছ ছিলো। সেখানে পাখির অভয়ারান্য ছিলো। সারাদিন যেখানেই থাক রাত হলেই পাখিরা এখানে এসে বসে থাকত। পাখির ডাকে সারারাত মেডিকেল মুখরিত থাকত। ২০০৭ সাল থেকে কথিত উন্নয়নের নামে গাছ কাটা শুরু হলেও রোপন করা হয়নি একটিও। পর্যায়ক্রমে ফাঁকা করা হচ্ছে মেডিকেলের সামনের স্থান। গত বছর পাখির পায়খানা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালকের গায়ে পড়লে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে পাখির বসবাসকৃত গাছের ডাল কেটে ফেলে। এনিয়ে মিডিয়া ও পরিবেশবিদরা স্বোচ্চার হলে এমন কান্ড তিনি আর করবেন না বলে প্রতিশ্রæতি দেন। কিন্তু বছর পেরুতেই তাঁর কথা ও প্রতিজ্ঞার বরখেলাপ করলেন পরিচালক।
তথা কথিত উন্নয়নের নামে শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে আবার গাছ কাটা শুরু করেছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে একটি গাছ কাটায় সেখান থেকে পড়ে শতাধিক শামুকখোল পাখির বাচ্চা মারা গেছে। শনিবার দুপুরের পর এই ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ বাচ্চা গাছ থেকে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আর যেগুলো বেঁচে ছিল, সেগুলোকে জবাই করে নিয়ে গেছেন নির্মাণ শ্রমিকেরা।
হাসপাতালের সামনের গাছগুলোতে কয়েক বছর ধরেই আবাস গড়েছে শামুকখোল পাখি। সেখানে পাখিরা ডিম দেয় এবং বাচ্চা ফুটায়। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের সামনে ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। আর তাই সেখানে কাটা হয়েছে একটি অর্জুন গাছ। সেই গাছ থেকেই পড়েছে পাখির বাচ্চাগুলো। সেখানে ২০ থেকে ২৫টি মৃত পাখির বাচ্চা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জবাই করা আরও কিছু শামুকখোলের বাচ্চা বস্তায় ভরছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। তাদের একজন গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ীহাট এলাকার বকুল (২২)। বকুল বলেন, গাছটি পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাখির বাচ্চাগুলোও পড়ে যায়। যেগুলো বেঁচে ছিল, সেগুলো তাঁরা জবাই করেন। এখন বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।
বকুলসহ আরো কয়েকজন শ্রমিককে অন্তত ৩০টি বাচ্চা বস্তায় ভরে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলেন পাবনার দাশুরিয়া থেকে আসা এক রোগীর স্বজন মিলন প্রামাণিক (৪০)। মিলন বলেন, সব মিলিয়ে শতাধিক পাখির বাচ্চা মাটিতে পড়ে গেছে। দুপুরের দিকে অনেক রোগীর স্বজনেরাও কিছু পাখির বাচ্চা নিয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী ও উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌসের নম্বরে কল করা হলে তাঁরা রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য নেয়া যায়নি।
রামেক হাসপাতালে পাখির বাচ্চার এমন মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কর্মকর্তা রাহাত হোসেন। তিনি বলেন, শুধু পাখির বিষ্ঠার কারণে ছয়মাস পূর্বে রামেক হাসপাতালে গাছ ও গাছের ডালপালা কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন পরিচালক। সে সময়ে তারা দেখা করলে পরিচালক আর কখনো পাখির আবাস্থল ধ্বংশ করবেন না বলে প্রতিশ্রæতি দেন। গাছ কেটে পাখি মেরে ফেলা বিষয়ে জানতে পেরে তিনি তার দল নিয়ে রাতেই সেখানে যান। নিয়ে তারা রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিলে সাথে সাক্ষাত করেন।
রাহাত আরো বলেন, জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রæতি দেন এবং আর যেন পাখির আবাসস্থল কেটে ফেলা না তার ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ঠিকাদার কর্তৃক তারা জানতে পারেন মেডিকেলের বর্তমান পরিচালক আরো সাঁইত্রিশটি গাছ কাটার জন্য নিলাম করেছেন। জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে কোন কাজ করতে না পারলে তারা বন্য প্রাণী আইনে মামলা করবেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, গাছ কাটার কারণে এতগুলো পাখির বাচ্চার মৃত্যু হলো। পাখিদের প্রতি এমন অবহেলা ও নিষ্ঠুরতা মেনে নেওয়া যায় না। যেখানে পাখির বাচ্চাদের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখানো হয় না, সেখানে মানুষের কি চিকিৎসা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এই কর্মকর্তাসহ আরো অনেকে।
এদিকে বাংলাদেশে প্রচলিত বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ তে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ‘‘অভয়ারণ্য’’ অর্থ কোন এলাকা যেখানে বন্যপ্রাণী ধরা, মারা, গুলি ছোড়া বা ফাঁদ পাতা নিষিদ্ধ এবং মুখ্যত বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে সকল প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন-উদ্ভিদ, মাটি ও পানি সংরক্ষণের নিমিত্তে ব্যবস্থাপনা করা হয় এবং যাহা এই আইনের ধারা ১৩ অনুসারে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষিত।
অথচ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের পরিচালক আইনের কোন তোয়াক্কা না করে বার বার একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছেন বলে মেডিকেলে আসা একাধিক ব্যক্তি উল্লেখ করেন। তারা বলেন, কাজ করতে হলে আর একমাস পরে করলে কি হত। তাহলে পাখির বাচ্চাগুলো বড় হতো। এতে পাখির কোন ক্ষতি হতনা। তারা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন।
এবিষয়ে সেভদি নেচার এন্ড লাইফ এর চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের পরিচালক যা করছেন তা সম্পূর্ণ অমানবিক ও নিষ্ঠুরতা। পাখিগুলো মেডিকেলের মধ্যে নিরাপদ বোধ করেছে বলে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি বলেন, এই পরিচালক বিগত এক বছরে চারশত গাছ তিনি কেটেছেন। আবারও ৩৭টি গাছ কাটার টেন্ডার দিয়েছেন। আর শনিবার যে গাছটি কাটা হয়েছে ওষধী এবং বিলুপ্তির পথে অর্জুন গাছ। সকল বাধা উপেক্ষা করে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই কাজ করছেন। পাখি হত্যা এবং অমানবিকতার কারনে তাঁর কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। আগামীকাল এনিয়ে তারা মানববন্ধন করার কথা বলেন এই পরিবেশবাদি।