নিজস্ব প্রতিবেদক: বীর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সাগরাম মাঝি এঁর ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির আয়োজনে গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট পৌরসভার সুন্দরপুর যুক্তিপাড়া পারগানা বাইশি প্রাঙ্গনে তাঁর মৃত্যুাষির্কী উপলক্ষে স্মরণসভা করা হয়। আজ বুধবার বিকেলে স্বরণসভা শুরুর আগে তাঁর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাঁর বর্নাঢ্য জীবনের উপর আলোচনা করা হয়। স্মরণসভায় রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা বেনজামিন টুডুর সভাপতিত্বে সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর রুহুল আমিন প্রামানিক, যোগেন্দ্র নাথ সরেন, চিত্তরঞ্জন সরদার, সুসেন কুমার শ্যামদুয়ার ও মুন্ডুমালা কলেজের প্রভাষক ও সাগরাম মাঝির কন্যার ছেলে সুনিল কুমার মাঝি।
অনুষ্ঠানে অত্র একাডেমির সংগীত প্রশিক্ষক মানুয়েল সরেনের সঞ্চালনায় আরো উপস্থিত ছিলেন, আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ঠাকুর মার্ডি, একাডেমির সংগীত প্রশিক্ষক কবীর আহম্মেদ বিন্দু, নাটক প্রশিক্ষক লুবনা রশিদ সিদ্দিকা কবিতা, সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহ্জাহান, গোদাগাড়ী উপজেলা পারগানা বাবুলাল মুর্মু ও সাধারণ সম্পাদক দিনেশ হাঁসদাসহ অত্র একাডেমির অন্যান্য কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
আলোচকবৃন্দ সাগরাম মাঝির কর্মময় জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করতে যেয়ে বলেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কেন্দুবুনা পাড়ায় ১৯০১ সালে জন্মগ্রহন করেন অবিংসবাদিত আদিবাসী নেতা ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সাগরাম মাঝি। আদিবাসী সমাজে শিক্ষার কোন গুরুত্ব না থাকলেও তিনি ভর্তি হন চব্বিশনগর মাদ্রাসায়। সেই মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন এবং আরবী শিক্ষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। এরপর তিনি পড়াশোনার সুযোগ পাননি।
পরবর্তীতে তিনি দেলশাদপুর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে এলাকায় ব্যাপকভাবে চেষ্ঠা চালিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠাগার তৈরী করেছিলেন। এছাড়াও আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে মেসে থেকে পড়ালেখা করার জন্য রাজশাহীতে তিনি একটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন। আজও তা বিদ্যমান রয়েছে বলে আলোচকবৃন্দ উল্লেখ করেন।
একজন আদিবাসী তদুপরি অনগ্রসর জাতির মানুষ সাগরাম মাঝির শিক্ষার সংগ্রাম সচেতন মানুষকে অনুপ্রানিত করেছিল বলে জানান তারা। একসময় তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং অল্প দিনের মধ্যেই তিনি সমাজ সেবক হিসেবে যথেষ্ঠ পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেন। ফলে তাঁর নাম বরেন্দ্র অঞ্চলে দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে।
তারা আরও বলেন, সামরাম মাঝি ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এম.এল.এ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে জয়লাভের পর তার পরিচিতি এলাকা ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ও প্রথম আদিবাসী নেতা যিনি পার্লামেন্টর সদস্য হিসেবে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র নির্বাচিত পার্লামেন্টারিয়ান, যিনি তৎকালীন বৃহত্তর রাজশাহী তথা উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র ভুমি থেকে আদিবাসীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তিনি ১৯৬২ সালে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৭০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে আবারও অংশগ্রহন করেন। নির্বাচনে তিনি হেরে যান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থানীয় সরকার কাঠামোর অধীনে গোদাগাড়ীর গোগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে প্রচুর ভোটে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
তবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। কারন একদিকে বয়সের ভার অন্যদিকে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শারীরিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন। শেষে ১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তিনি টিবি হাসপাতালেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন বলে জানান তারা।