রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:১৯ পূর্বাহ্ন

যোগ্যতা ছাড়াই চাকরি পেয়েছেন রনি,কাল্পনিক পদে পেয়েছেন পদোন্নতিও

  • প্রকাশ সময় রবিবার, ৫ মে, ২০২৪
  • ১৯ বার দেখা হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: অভিজ্ঞতার শর্ত লঙ্ঘন করে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় (রুয়েট) সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা। পরে অনুমোদনহীন কাল্পনিক পদে তাঁকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। মুফতি মাহমুদ রনি নামের এই কর্মকর্তা এখন রুয়েটের অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) পদে বসে আছেন। রুয়েটের অনুমোদিত জনবল গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তরে অতিরিক্ত পরিচালকের পদই নেই।

মুফতি মাহমুদ রনির কর্মকর্তার চাকরি ফাইলের সমস্ত নথি ঘেঁটে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভয়াবহ অনিয়ম দেখা গেছে। রনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি), রাজশাহীর যন্ত্রকৌশল বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সে সময় বিআইটি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি বিআইটি থেকে বেরিয়ে যান। এই প্রতিষ্ঠানটিই পরে রুয়েট হয়।

নথিপত্রে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর রুয়েটে দুটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তখন সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরির জন্য আবেদন করেন রনি। ২০১১ সালের ২৫ মে অনুষ্ঠিত রুয়েটের ৫০তম সিন্ডিকেট সভায় সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদের বিপরীতে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে রনিকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। পরে ৩০ মে রুয়েটের তৎকালীন রেজিস্ট্রার রনির নিয়োগাদেশ জারি করেন। এতে বলা হয়, প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়োগ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এই নিয়োগ দেওয়া হলো।

রুয়েট সূত্র বলছে, ঐ সময় রুয়েট প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে নিজের মতো করেই নিয়োগের শর্ত করে নেন রনি। ফলে তিনি চাকরি পেয়ে যান। পরে যে নীতিমালা হয় তাতে সপ্তম গ্রেডের এ চাকরির জন্য সরকারী/আধা-সরকারী/স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসনিক/একাডেমিক/পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কিন্তু রনি ঐ সময় এস এম এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লিয়াজোঁ অফিসার পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা সনদেই চাকরি পেয়ে যান।

কিন্তু এই চাকরি নিয়েই থেমে যাননি রনি। যোগ্যতা না থাকলেও ২০১৬ সালে রুয়েটে বাগিয়ে নেন আরও বড় পদের চাকরি। ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট রুয়েট আবার চারটি পদের বিপরীতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে রনি উপ-পরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) পদে আবেদন করেন। বিজ্ঞাপনে এই পদের জন্য শর্ত ছিল, সরকারী/আধা-সরকারী/স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে গবেষণা ও সম্প্রসারণ কিংবা প্রশাসনিক কাজে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা। কিন্তু রনি তখন আবার সেই এস এম এন্টারপ্রাইজে ৬ বছর ৫ মাস ১১ দিন ও রুয়েটে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে ৪ বছর ৮ মাস চাকরির অভিজ্ঞতা দেখান। এই অভিজ্ঞতা চাকরির শর্ত পূরণ না করলেও বিশেষ খাতিরে রনিকে আবার চাকরি দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ৮০তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৯ এপ্রিল নিয়োগাদেশ জারি করেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার।

রুয়েট সূত্র জানায়, চাকরি পেয়েই রুয়েটে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করতে শুরু করেন রনি। জিম্মি করে ফেলেন রুয়েট প্রশাসনকে। হয়ে যান রুয়েট কর্মকর্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদকও। এরপর নিজের পদোন্নতির জন্য চাপ দিতে থাকেন রুয়েট প্রশাসনকে। শেষে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর রনিকে উপ-পরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) পদ থেকে পদোন্নতি দিয়ে একই দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক করা হয়। তাঁকে চাকরির চতুর্থ গ্রেড দেওয়া হয়।

অথচ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনুমোদিত রুয়েটের যে জনবলকাঠামো রয়েছে তাতে অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) নামে কোন পদই নেই। তারপরও অস্তিত্বহীন-কাল্পনিক এই পদে রনিকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এখন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারের সমমান ধরে চতুর্থ গ্রেডে রনিকে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। অথচ ইউজিসির সার্কুলার অনুযায়ী শুধু রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অর্থ ও হিসাব এবং লাইব্রেরী দপ্তরের জন্য চতুর্থ গ্রেডের পদ সৃষ্টি করা যাবে। এই দপ্তরগুলোতে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে প্রথম শ্রেণির পদে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীকে চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তরে চতুর্থ গ্রেড সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই। তারপরও রনির জন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তরে অতিরিক্ত পরিচালকের কাল্পনিক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ১০ বছরের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে রনি এই পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন।

নথিপত্রে আরও দেখা গেছে, মুফতি মাহমুদ রনি ২০০৮-০৯ সেশনে রুয়েটের এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। তাঁর এই ডিগ্রি চলমান অবস্থায় ২০১২ সালে তিনি অবৈধভাবে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং বিভাগে এমবিএ করেছেন। শিক্ষা সনদের বিধি ভঙ্গ করে একইসঙ্গে চলমান দুটি ডিগ্রি তিনি তাঁর চাকরি ফাইলেও নথিভুক্ত করেছেন।
রনি এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জনে থিসিস জালিয়াতি করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি ০৭২০৯৯ রোল নম্বরের মোস্তাফিজুর রহমান ও ০৭২০৬২ রোল নম্বরের কামরুন নাহার নামের দুই শিক্ষার্থীর যৌথ থিসিস পেপার নকল করে নিজের নামে জমা দিয়েছেন। রনির ০৮০৪২০২০০১ নম্বরের থিসিস পেপার দেখে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এতসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে মুফতি মাহমুদ রনি বলেন, ‘আমার যোগ্যতা ছিল বলেই কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিয়েছে। এমন তো নয় যে নিয়োগ বোর্ডে আমার কোন আত্মীয় ছিলেন। তাই নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাকে বিশেষ খাতির করার প্রশ্নই ওঠে না।’ অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে কাল্পনিক পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে রনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে কাল্পনিক পদে আপগ্রেডেশন নেওয়া প্রচলিত। এটা হয়।’ থিসিস জালিয়াতির বিষয়ে রনি বলেন, ‘ঐ দুই শিক্ষার্থী বিএসসির থিসিস করেছে। আর আমি করেছি এমএসসির। আমাদের একই শিক্ষক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। সঙ্গত কারণে থিসিসের কিছু বিষয় একই হয়েছে। এটি কোন জালিয়াতি বা কপি করার ঘটনা নয়।’

রনির যখন প্রথম চাকরি হয় তখন রুয়েটের উপাচার্য (ভিসি) ছিলেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল করিম চৌধুরী। অনিয়মের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘১৩ বছর আগের কথা। এখন এসব মনে নেই। তবে নিয়োগে চাপ তো ছিলোই। স্থানীয় নেতারা নিয়োগের সময় অনবরত ফোন করতেই থাকেন।’ অনিয়ম করে রনিকে উপ-পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অনেক আগের বিষয়। ফাইল না দেখে তো বলতে পারবো না।’ রনি যখন অতিরিক্ত পরিচালকের কাল্পনিক পদে পদোন্নতি পান, তখন ভিসি ছিলেন অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সেখ। আর রেজিস্ট্রার ছিলেন অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেন। তারা ফোন ধরেননি।

রুয়েটের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আরিফ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘তৎকালীন প্রশাসন তাকে কোন ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে চাকরি দিয়েছে তা আমার জানার কথা নয়। ফাইল দেখতে হবে। আর ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যদি নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে জালিয়াতি হয়েই থাকে তাহলে সে বিষয়ে সিণ্ডিকেট কিংবা ফাইলে নোট দিতে হবে।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো নিউজ দেখুন
© All rights reserved © 2021 dailysuprovatrajshahi.com
Developed by: MUN IT-01737779710
Tuhin