ফজলুল করিম বাবলু: ভিক্ষে বা চাঁদাবাজী নয়, কর্মের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আগ্রহী রাজশাহীর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা। নিজ বাড়ি থেকে বিতারিত হয়ে হিজড়া গুরুর নিকট বেড়ে উঠা এই জনগোষ্ঠির অনেকেই এখন লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হয়ে গড়ে উঠছে। আবার অনেকেই তাদের চিরাচরিত পেশা থেকে বেড়িয়ে এসে নিজে ভাল কাজ করে নিজের জীবন গড়তে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
দেশে এখন কোভিড-১৯ নানা ধরনের ধরন চলছে। এতে করে অন্যান্য জাতীগোষ্ঠির মানুষের ন্যায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো অসহায় হয়ে পড়েছে। যারা কর্ম করতেন তাদেরও কর্ম চলে গেছে। এ অবস্থায় তারা আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা শুরু করেছে ছোট ছোট ব্যবসা।
এমনি তৃতীয় লিঙ্গের প্রিয়া রানী ও রতন। এই দুইজন ব্যক্তিকে রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ফুল ও মাস্ক বিক্রি করতে দেখা যায়। তাদের সাথে নগরীর পদ্মাগার্ডেনে কথা হয়। এসময়ে তারা উভয়ে বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে নগরীর বিভিন্ন স্থানে তারা গোলাপ ফুল ও মাস্ক বিক্রি করে আসছেন। প্রতিদিন তাদের বিক্রি ভাল এবং লাভও হচ্ছে। এ দিয়ে তাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে বলে জানান।
তারা আরো বলেন, দুইমাস পূর্বেও তারা বিভিন্ন বাসা বাড়িতে যেয়ে চাঁদা আদায় করতেন। অনেকে নানা কথা বলতো। টাকার জন্য তাদের নানা অঙ্গভঙ্গি ও অশ্লিলতা করতে হতো। এখন সে সমস্যা নাই। তারা আরো বলেন, প্রথম প্রথম তাদেরকে অনেকেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতো। কিন্তু সময়ে বিবর্তনে এখন নগরীর পদ্মার পারসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র স্থানে ঘুড়তে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষেরা তাদের নিকট হতে ফুল ও মাস্ক ক্রয় করে প্রিয়জনকে দিচ্ছে। সেইসাথে তাদের কর্মের জন্য ধন্যবাদ প্রদান করছে বলে জানান তারা।
প্রিয়া রানী বলেন, রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা দিনের আলো হিজড়া সংঘের সভাপতি মোহনা এই কাজের জন্য তাদের উৎসাহীত করেছেন। তাঁর অনুপ্রেরনা ও আর্থিক সহযোগিতায় তারা ঘুড়ে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নেমে পড়েছেন। আগামীতে এই শহরে তারা ফুলের দোকান করতে চান। আর তাদের সহযোগিতা করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সমাজের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহবান জানান তারা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে দিনের আলো হিজড়া সংঘের সভাপতি মোহনা বলেন, তিনি এই জনগোষ্ঠির একজন। তিনিও অনেক কষ্ট করে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এই পর্যায়ে এসেছেন। অনেকদিন তাঁকে না খেয়ে দিনাদিপাত করতে হয়েছে। মানুষের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হয়েছে। সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় কোথাও তারা দাঁড়াতে পারতেন না। অপমান ও ক্ষুধার যে কি কষ্ট তিনি তা ভাল করে জানেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে অতিতের অবস্থা থেকে নিজেকে ফিরে আনতে আপ্রান চেষ্ঠা করেছেন তিনি। যার ফল আজকে তিনি পেয়েছেন। তিনি এখন স্বাবলম্বী।
মোহনা বলেন, বাচ্চা নাচানো ও চাঁদাবাজী থেকে বিরত রাখার লক্ষে তাঁর মতো এই জনগোষ্ঠির জনগণকে কর্মমূখী করে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমান সরকার যেমন তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেইসাথে পিতার সম্পদে অংশিদারিত্ব নিশ্চিত করেছেন। সরকারের এই পদক্ষেপকে তিনি স্বাগত জানান। তিনি আরো বলেন, সরকার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করেছেন। এখন তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহন করছেন। কোথাও কোথাও নির্বাচিত হচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, রাজশাহীর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কর্মের ব্যবস্থা করতে বিউটি পার্লার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। শুধু বিউটি পার্লার নয় এখন পরীক্ষামূলকভাবে প্রিয়া রাণী ও রতন নামে দুইজনকে ফেরি করে নগরীর বিনোদন কেন্দ্রগুলোসহ বিভিন্ন স্থানে ফুল বিক্রি করার ব্যবস্থা করেছেন। এতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। আগামীতে আরো তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের ভিন্ন ভিন্ন কর্মে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন বলে আশাব্যক্ত করেন মোহনা। সেইসাথে চাকুরী ও লেখাপড়ার জন্য কোটা পদ্ধতি চালু করার জন্য সরকারের নিকট অনুরোধ করেন এই তৃতীয় লিঙ্গের নেত্রী।