নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ কৃষি প্রধান একটি দেশ। এই দেশের মাটি এতটাই উর্বর যে যেখানেই বীজ রোপন করা যায়, সেখানেই ফসল ও গাছ-পালা জন্মে। শুধু রোপন নয় পাখির পুরিষের মাধ্যমে বীজ মাটিতে পড়লে সেখান থেকেও বৃক্ষ জন্মায়। এক কথায় বাংলার মাটি ফসল উৎপাদনের ঘাটি। এরই প্রমানস্বরুপ রয়েছে রাজশাহীর পদ্মা নদীর চর। প্রমত্তা পদ্মার চর বর্ষা মৌসুমে ডুবে যায়। সে সুবাদে অত্র চরে পরে পলি ও বালি মাটি। দোআঁশ মাটি হওয়ার চরের মাটি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। পূর্বে চরে তেমন কোন ফসল হতনা। কিন্তু বর্তমানে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি উপসহকারীদের সার্বক্ষণিক তত্বাবধানে ও পরামর্শে পবার হরিপুর ইউনিয়নের খোলাবনা এলাকার পদ্মার চরে চাষ হচ্ছে বাংলার আপেলখ্যাত বিভিন্ন জাতের টমেটো।
পবার খোলাবোনা এলাকার পদ্মার চরের জমির মালিক হরিপুর এলাকার কৃষক আসাদুল হক, আব্দুস সোবাহান ও সিদ্দিক বলেন, এই চরে প্রায় শত বিঘা জমিতে টমেটোর চাষ হচ্ছে। মাচান পদ্ধতিতে চাষ করায় টমেটো খুব ভাল হয়েছে। খরচ একটু বেশী হলেও বাজারে দাম বেশী থাকায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। তারা আরো বলেন, এই মাঠ থেকে শুধু টমেটো বিক্রি করে এবার কোটি টাকার উপরে কৃষকরা লাভ করতে পারবেন। কৃষকরা আরো বলেন, মানবদেহের ক্ষতিকারক ইথিফন বা অন্যকোন খারাপ হরমন ব্যবহার করে তারা টমেটো পাকান না। প্রকৃতির নিয়মে গাছে টমেটো পাকার পরে তারা তুলে বাজারে বিক্রি করেন।
কৃষকরা বলেন, তারা জৈব সার অনেক বেশী ব্যবহার করেন। রাসায়নিক সার যতটুকু প্রয়োজন তার থেকেও কম ব্যবহার করেন তারা। ফলে টমেটো অত্যন্ত সুস্বাদু হয় বলে জানান তারা। তারা বলেন, যে ভাবে টমেটো আসছে এবং বাজাওে বর্তমানে যে দাম রয়েছে তাতে এবারে তারা ভাল লাভবান হবেন বলে উল্লেখ করেন।
কৃষকরা আরো বলেন, টমেটো শেষ হলেই তারা একই জমিতে শশার চাষ করবেন এবং একই মাচান ব্যবহার করবেন। এতে তারা আরো বেশী লাভবান হবেন বলে উল্লেখ করেন। কৃষক সিদ্দিক বলেন, বিগত বছরগুলোতে এই পদ্মার চরে কৃষি অফিস থেকে কেউ আসতেন না। কিন্তু এবারে আশরাফুল ইসলাম নামে একজন কৃষি উপসহকারী এই চরে আসছেন এবং তাদের টমেটোসহ অন্যান্য ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে করে তারা খুব উপকৃত হচ্ছেন। সেইসাথে আশরাফুলের পরামর্শে জমিে জৈব কিটনাশক, আঠালো হলুদ ষ্ট্রিপ্স ও সেক্স ফেরোমন পোকা মারা ফাঁদ দেয়ায় পোকার আক্রমণ থেকেও তারা ফসলকে বাঁচাতে পারছেন বলে উল্লেখ করেন তিনিসহ অন্যান্য কৃষকরা।
রোগবালাই ও দমন এবং চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে পবা উপজেলা আলিমগঞ্জ ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার আশরাফুল ইসলাম বলেন, দোআঁশ ধরনের মাটি টমেটো চাষের জন্য উত্তম। টমেটো চাষের পূর্বে জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। গ্রীষ্মকালে টমেটো চাষের জন্য ২০-২৫ সেমি উঁচু এবং ২০-৩০ সেমি চওড়া বেড তৈরি করতে হয়। সেচ দেওয়ার সুবিধার্থে ২টি বেডের মাঝে ৩০ সেমি নালা রাখতে হয়। প্রতিটি বেডে ২ সারি করে ৬০ বাই ৪০ সেমি দূরত্বে ২৫-৩০ দিন বয়সের চারা রোপণ করা যায়। মধ্য-কার্তিক থেকে মাঘের ১ম সপ্তাহ (নভেম্বর থেকে মধ্য-জানুয়ারি) পর্যন্ত টমেটোর চারা রোপণ করা যায়। তবে দাম ভাল পাওয়ার আশায় পদ্মার চরের কৃষকরা অক্টোবরের পনের তারিখ এর মধ্যে থেকে শুরু করে নভেম্বর মাসের শেষের দিক পর্যন্ত চারা রোপন করেন বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, টমেটো উৎপাদনের জন্য হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ সার প্রয়োগ করতে হয়। হেক্টর প্রতিগোবর ৮-১২ টন, ইউরিয়া ৫০০-৬০০ কেজি, টিএসপি ৪০০-৫০০ কেজি,এমপি ২০০-৩০০ কেজি। অর্ধেক গোবর ও টিএসপি সার শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে দিতে হয়। অবশিষ্ট গোবর চারা লাগানোর পূর্বে গর্তে প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়াও ইউরিয়া ও এমপি ২ কিস্তিতে পার্শ্বকুশি ছাঁটাই এর পর চারা লাগানোর ৩য় ও ৫ম সপ্তাহে রিং পদ্ধিতিতে প্রয়োগ করতে হয় বলে জানান আশরাফুল।
শুধু চারা রোপিন করলেই হবেনা। প্রথম ও ২য় বার সার প্রয়োগের পূর্বে পার্শ্বকুশিসহ মরা পাতা ছাঁটাই করে দিতে হয়। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয় এবং ফলের আকার বড় হয়। হরমোন প্রয়োগের সুবিধার্থে এবং প্রবল বাতাসে গাছ যাতে নুয়ে না পড়ে সেজন্য কৃষকরা এই মাচান পদ্ধতিতে টমেটোর চাষ করছেন বলে জানান তিনি।
রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাতা কোঁকড়ানো, পাতা হলদে হয়ে যাওয়া, পাতায় মরিচা ধরা ও গোড়াপঁচা রোগ হয়। এগুলো দমনে বাজারে প্রচলিত এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত ছত্রাক নাশক উপসহকারী কৃষি অফিসারের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও টমেটোতে সাদা মাছি, থ্রিপ্স, জাব পোকা, মাকড় ও ফল ছিদ্রকারী পোকা আক্রমণ করে। এ থেকে রক্ষা পেতে বাজারে প্রচলিত ও অনুমোদিত কিটনাশক ব্যবহার করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সেইসাথে জৈব কিটনাশক আঠালো হলুদ ষ্টিক ও সেক্স ফেরোমন পদ্ধতি ব্যবহার করলে অর্থও বাঁচবে এবং মানুষ রাসায়নিক কিটনাশক থেকে রক্ষা পাবে বলে জানান আশরাফুল ইসলাম।